লোকজন শঙ্কিত পাংশু মুখে আল্লাহকে ডাকতে থাকে।
বড় সাগরেদ বক্তৃতা দেয়ার ভঙ্গিতে আবার শুরু করেন, হুঁজুরের শরীরে এখন ব্যথা-বেদনা নেই। কী ভাবে থাকবে, শরীরে যদি রুহ না থাকে সেখানে ব্যথা-বেদনা কোথেকে আসবে? আপনারা যদি বিশ্বাস না করেন তাহলে এক্ষুনি দেখবেন, হুঁজুরের শরীরকে খাড়া পেরেকের উপর রেখে দেব, হুঁজুর তার উপর যেন ভেসে থাকবেন।
হুঁজুরের ইয়া লাশ, ঘি-দুধ খেয়ে মোটা খোদার ইচ্ছায় একটু বেশিই হয়ে গেছেন, চর্বির জন্যে তাঁকে ভালো করে ধরা যায় না, পিছলে যেতে চান। তাঁকে টেনে আনতে গিয়ে দশ বার জন মুশকো জোয়ানের কালঘাম ছুটে গেল। হুঁজুরকে কোনোমতে টেনে এনে সেই পেরেকের বিছানাতে শশাওয়ানোমাত্র একটা মজার জিনিস ঘটে গেল, হুঁজুর হঠাৎ “বাবা গো” বলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়ার চেষ্টা করেন। লোকজনের ভেতর একটা বিস্ময়ের গুঞ্জন শুরু হয়ে হঠাৎ থেমে যায়। সাগরেদরা হতভম্ব। বড়। সাগরেদ সবচেয়ে আগে সম্বিত ফিরে পান, ভয়ের ভঙ্গিতে বললেন, নাউজুবিল্লাহ্ নাউজুবিল্লাহ্ নাউজুবিল্লাহ—আপনারা দরুদ শরিফ পড়েন, সবাই জোরে জোরে দরুদ শরিফ পড়েন, জোরে জোরে।
দরুদ শরিফের আওয়াজে আর কিছু শোনা যায় না, পীর সাহেবের কারেনি চাপা পড়ে গেল। পীর বাবা লাফিয়ে উঠে পড়তে চাইছিলেন, কিন্তু সাগরেদরা তাঁকে ঠেসে ধরে রাখল, তার মাঝে এক জন জোর করে বুকের মাঝে একটা তক্তা বিছিয়ে দিয়ে দুটো থান ইট এনে রেখে দেয়। আমি দেখতে পেলাম আতঙ্কে পীর বাবার চোখ গোল-গোল হয়ে উঠেছে, কী একটা বলে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন ছাড়া পাবার জন্যে, কিন্তু সাগরেদরা তাঁকে কিছুতেই ছাড়ছে না। কালু খাঁয়ের লাখ টাকার লোভ খুব সহজ ব্যাপার নয়। গুণ্ডা গোছের এক জন লোেক প্রকাণ্ড একটা হাতুড়ি নিয়ে হাজির হয়। পীরবাবার প্রচণ্ড চিল্কার অগ্রাহ্য করে সেই হাতুড়ির প্রচণ্ড আঘাতে সে থান ইট দুটি গুড়ো করে ফেলে। সাথে সাথে পীর বাবা এক গগনবিদারী চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠেন, দশ জন সাগরেদ তখন তাঁকে ধরে রাখতে পারে না, তিনি বাবা গো, মা গো, মেরে ফেলল গো বলে চিৎকার করে লাফাতে থাকেন। দর্শকরা হতচকিত হয়ে একেবারে নীরব হয়ে যায়। সাগরেদরা দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে রীতিমতো কুস্তির ভঙ্গিতে গদিতে আছড়ে ফেলল, বড় সাগরেদ তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে কী একটা বলতে থাকেন আর পীর সাহেব প্রবল বেগে মাথা নেড়ে আপত্তি করতে থাকেন। কয়জন সাগরেদ ছুটে গিয়ে ব্যান্ডেজ মলম এনে তাঁকে উল্টে ফেলে পিঠে একটা ব্যান্ডেজ করে দিল—সিকের সাদা পাঞ্জাবিতে রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছিল, তাঁকে চেপে শুইয়ে রেখেই পাঞ্জাবি বদলে দেয়া হল।
উপস্থিত দর্শক তখন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। কথাবার্তায় আসর রীতিমতো সরগরম। হঠাৎ দেখি নান্টু তার কাগজের বান্ডিল নিয়ে গুটিগুটি এগিয়ে আসছে। আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে আটকে নিচু গলায় বললাম, এক্ষুনি নয়, আরেকটু পর।
খুশিতে নান্টুর দাঁত বেরিয়ে ছিল, সেগুলো লুকানোর কোনো চেষ্টা না করে বলল, আরো মজা আছে?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
নান্টু হাতে কিল মেরে বলল, নদী মে খাল, মিরচা মে ঝাল।
শেষ পর্যন্ত বড় সাগরেদ উঠে দাঁড়ালেন, কেশে গলা পরিষ্কার করতেই উপস্থিত জনতা একেবারে চুপ করে যায়। বড় সাগরেদ হুঁঙ্কার দিয়ে বললেন, আমি এক শ’ বার বললাম যার অজু নাই সে যেন জিকিরে যোগ না দেন, কিন্তু আপনাদের মাঝে এক জন আমার কথা শুনেন নাই, অজু ছাড়া জিকিরে টান দিয়েছেন।
উপস্থিত জনতা পাংশু মুখে বসে থাকে। বড় সাগরেদ চিৎকার করে বললেন, হুঁজুরের জানের জন্যে যার মায়া নাই, জাহান্নামে তার জায়গা নাই। খবরদার বে-অজু মানুষ জিকিরে সামিল হবেন না।
পীর বাবা আবার জিকির শুরু করেন, এবারে তাঁর সাথে যোগ দিল অল্প কিছু লোক, অজু সম্পর্কে সন্দেহ নেই, এরকম লোকের সংখ্যা বেশি নয়। পীর বাবার সমাধিস্থ হতে বেশি সময় লাগল না। লাখ টাকার লোভ খুব সহজ জিনিস নয়। বড় সাগরেদ আবার উঠে দাঁড়িয়ে গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, হুঁজুরের রুহ এখন সাত আসমান সাত জমিন পার হয়ে উঠে গেছেন, হুঁজুরের শরীরে এখন ব্যথা-বেদনা নাই। খবরদার, আপনারা কেউ শব্দ করবেন না, রুহ্ তাহলে শরীরে ফিরে আসতে চায়। তখন রুহের কষ্ট হয়, শরীরে আজাব হতে পারে। খোদার রহমত মানুষের শরীরে নাজেল হলে মানুষের শরীর ফিরিশতার শরীর হয়ে যায়। আপনারা এখন তার প্রমাণ দেখবেন।
আগুনের বড় কুণ্ডতে অনেকক্ষণ থেকে বেশ কয়টা কাঠের গুড়ি দাউদাউ করে জ্বলছিল, এবারে সাগরেদরা এসে গনগনে কয়লাগুলি সমানসমান করে বিছিয়ে দিতে থাকে। প্রায় দশ ফুট লম্বা দুই ফুট চওড়া জ্বলন্ত কয়লার একটা রাস্তা তৈরি হয়, পীর বাবা সেটার উপর দিয়ে হেঁটে যাবেন। আধো অন্ধকারে জ্বলন্ত কয়লার লাল আভা দেখে ভয় ভয় করতে থাকে, এর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। সফদর আলী অবশ্যি বুঝিয়ে দিয়েছেন পা ভিজিয়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে গেলে ব্যাপারটি তেমন কঠিন নয়। আজ অবশ্যি অন্য ব্যাপার, সফদর আলী ব্যবস্থা করে রেখেছেন, সব ভণ্ডামি আজ ধরা পড়ে যাবে। পেরেকের বিছানাটি এত চমৎকার কাজ করেছে যে এবারেও সফদর আলীর ব্যবস্থাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই!
পীর বাবা অনেকক্ষণ থেকেই অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছেন, সবাই মিলে তাঁর পা ভালো করে ধুয়ে দিয়ে ধরাধরি করে জ্বলন্ত কয়লার কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। পীর বাবা টলতে টলতে দুলতে দুলতে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকেন। পিছন থেকে বড় সাগরেদ একটা ধাক্কা দিতেই তিনি এক পা কয়লার উপরে দিলেন। মুহূর্তে তাঁর ভাবগম্ভীর মুখ বিবর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি এক লাফে পিছিয়ে আসতে চাইলেন। কিন্তু বড় সাগরেদ আবার তাঁকে ধাক্কা মেরে জ্বলন্ত কয়লার দিকে ঠেলে দিলেন। পীর বাবা নাকমুখ খিচিয়ে কোনোমতে দুই পা সামনে এগিয়ে গেলেন, তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার করে বাবা গো, মা গো, মেরে ফেললে গো বলে লাফাতে লাফাতে জ্বলন্ত কয়লা থেকে বেরিয়ে এলেন। তার বিরাট থলথলে শরীর নিয়ে তিনি বারকতক ঘুরপাক খেয়ে বড় গামলা ভর্তি শরবতে নিজের পা ড়ুবিয়ে দিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকেন। এর মাঝে কয়েক বার ফ্লাশের আলো জ্বলে উঠল। আমার সাংবাদিক বন্ধু নিশ্চয়ই ছবি তুলে নিয়েছে।