আমার দু’নম্বর কাজটি শেষ। তিন নম্বর কাজটি একটু কঠিন। পেরেকের বিছানায় শোওয়া এবং জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে হাঁটার রহস্যটা একটা কাগজে লিখে ফেলা। লেখালেখি ভালো আসে না আমার, বিস্তর সময় লেগে গেল। শুধু লিখেই শেষ নয়, সেটা আবার ফটোকপি করে শ’খানেক কপি করে ফেলতে হল, নিজের পকেটের পয়সা খরচ করেই।
শেষ কাজটি কঠিন নয়, কিন্তু বিপজ্জনক। পীর বাবার বুজরুকি ধরার জন্যে কিছু ছোটখাট ব্যবস্থা করা, তার আস্তানায় সেদিনই করতে হবে, আগে থেকে করে রাখার উপায় নেই। সফদর আলী অবশ্যি ভরসা দিয়েছেন তিনি ঠিক ঠিক করে নেবেন, ধরা পড়ে ভক্তদের হাতে মার খাওয়ার একটা আশঙ্কা আছে, কিন্তু মহৎ কাজে বিপদের ঝুঁকি না নিলে কোন মহৎ কাজটা করা যায়?
বুধবার সন্ধেবেলা আমি সময়মতো পীর বাবার দরবারে এসে হাজির হলাম। আসার সময় নিউ মার্কেটের সামনে থেকে একটা চালু গোছের বাচ্চাকে ধরে এনেছি, নাম নান্টু। তার সাথে কুড়ি টাকার চুক্তি, দশ টাকা অগ্রিম, বাকি টাকা কাজ শেষ হলে দেয়া হবে। কাজটি কঠিন নয়, পীর বাবার দরবারে যখন হৈচৈ লেগে যাবে, লোকজন চেচামেচি করতে থাকবে তখন ভেতরে ঢুকে “পীর বাবার জোচ্চুরি” “পীর বাবার জোচ্চুরি” বলে ফটোকপি করা কাগজ গুলো বিলি করতে হবে। শুনে ছেলেটা মহাখুশি, হাতে কিল মেরে বলল, ‘নদী মে খাল, মিরচা মে ঝাল!’
কথাটার মানে কি এবং কাগজ বিলি করার সাথে এর কি সম্পর্ক আমি বুঝতে পারলাম না। অবশ্যি বোঝার বেশি চেষ্টাও করি নি, ছোট বাচ্চাদের যদি বুঝতেই পারব, তাহলে ওরা আর বাচ্চা কেন?
পীর বাবার দরবারে ঢুকতেই বড় সাগরেদ একগাল হেসে এগিয়ে এলেন। গলার স্বর নিচু করে বললেন, খাঁ সাহেব এসেছেন?
আমি ভিড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, ওখানে বসে আছেন, এখন পরিচয় দিতে চান না। ভিড়টা কমে গেলে হুঁজুরের কাছে নিয়ে যাব।
সাগরেদের একটু আশাভঙ্গ হল বলে মনে হল, কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে আমার সাথে দীন, দুনিয়া এবং আখেরাত নিয়ে কথা বলতে থাকে। কথা বলতে বলতে আমি দরজার দিকে লক্ষ করছিলাম। সফদর সাহেবের আলাদাভাবে আসার কথা, তিনি এসে গেছেন। দরবারের কাছাকাছি পেরেকের চৌকিটা সাজানো আছে, একজন দু’জন সাহসী দর্শক কাছে এসে জিনিসটা ছুঁয়ে দেখছিল, লক্ষ করলাম সফদর আলীও দর্শকদের সাথে এসে চৌকিটার পেরেকগুলো টিপেটুপে দেখার অভিনয় করছেন, অত্যন্ত কাঁচা অভিনয়। ভালো করে লক্ষ করলে যে কেউ বুঝে ফেলবে। আমি বড় সাগরেদকে একটু ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু তার দরকার ছিল না, কারণ হঠাৎ দেখি সফদর আলী আগুনের কুণ্ডটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এর অর্থ পেরেকের চৌকিতে তাঁর কাজ শেষ হয়েছে। সফদর আলী আগুনের কুণ্ডর পাশে দাঁড়িয়ে সন্দেহজনকভাবে এদিকে সেদিকে তাকাতে থাকেন, আমি শঙ্কিতভাবে দেখি এক জন সাগরেদ তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। সাগরেদ সফদর আলীকে কী একটা জিজ্ঞেস করল। উত্তরে সফদর আলীও কী একটা বললেন। তারপর দু’জনে বেশ সহজভাবেই কথা বলতে থাকেন। সাগরেদ একটা লাঠি দিয়ে আগুনটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জ্বালাতে থাকে। সফদর আলীও তাকে সাহায্য করতে থাকেন। আমি ভয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি, সাগরেদের এত কাছে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর কাজটা শেষ করতে গিয়ে যদি ধরা পড়ে যান, তাঁর কী অবস্থা হবে, আমি চিন্তা করতে পারি না। খানিকক্ষণ পর ভয়ে ভয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি ফিরে যাচ্ছেন। আমার চোখে চোখ পড়তেই তিনি মুচকি হেসে একটু মাথা নাড়লেন। বুঝতে পারলাম কাজ শেষ, আমার বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে যায়।
নির্দিষ্ট সময়ে পীর বাবা এসে দরবারে হাজির হন। চার ফুট লম্বা লাশ, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রায় সমান সমান। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। গাল দুটিতে একটা গোলাপি আভা। মাথায় একটা জমকালো জরিদার পাগড়ি। পরনে সাদা সিলকের পাঞ্জাবি। সাদা সিলকের লুঙ্গি। পীর বাবা মুখে একটা মৃদু হাসি নিয়ে এসে মখমলের গালিচাতে বসলেন। সাথে সাথে উপস্থিত জনতার মাঝে একটা হুঁড়োহুড়ি পড়ে যায়—কে কার আগে এসে হুঁজুরের পা ধরে সালাম করতে পারবে। যাদের বাড়াবাড়ি একটু বেশি, তারা এসে হুঁজুরের পায়ের তলায় চুমো খাবার চেষ্টা করতে থাকে। হুঁজুর মুখে মৃদু হাসি নিয়ে ভক্তদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
একটু পরেই বড় সাগরেদ ঘোষণা করলেন যে, এখন হুঁজুর জিকির শুরু করবেন। যাদের অজু আছে তারা হুঁজুরের সাথে জিকির শুরু করতে পারে।
হুজুরের সামনে মস্ত বড় কাঁচের গামলায় ঠাণ্ডা শরবত রাখা আছে, হুঁজুর সেখান থেকে একগ্লাস শরবত তুলে এক ঢোক খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে সুরেলা স্বরে জিকির শুরু করেন। মাহফিলের শ’তিনেক লোক তাঁর সাথে তাল রেখে গলা ফাটিয়ে জিকির শুরু করে, শব্দে মনে হয় ঘরের ছাদ ফেটে বেরিয়ে যাবে। আস্তে আস্তে জিকিরের তাল দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে, হুঁজুরের শরীর কাঁপতে থাকে, চোখ ঘুরতে থাকে এবং কিছু বোঝার আগে হঠাৎ দড়াম করে মখমলের গণিতে পড়ে গিয়ে গোঁ গোঁ করতে থাকেন। বড় সাগরেদ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতেই উপস্থিত জনতা মুহূর্তে চুপ করে যায়। হুঁজুর তখনো গদিতে গোঁ-গোঁ শব্দ করে কাঁপছেন, কয়েকজন সাগরেদ। ছুটে এসে ভিজে তোয়ালে দিয়ে তাঁর মুখ মুছিয়ে পাখা দিয়ে খানিকক্ষণ বাতাস করার পর তিনি একটু শান্ত হন। বড় সাগরেদ গলা নামিয়ে বললেন, খবরদার, কেউ এখন জোরে শব্দ করবেন না, হুঁজুরের রুহ এখন অনেক উপরে চলে গেছে, তাঁর শরীরের সাথে এখন তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই। এখন হঠাৎ করে কেউ যদি হুঁজুরকে চমকে দেন তাঁর রুহ আর তাঁর শরীরে ফিরে নাও আসতে পারে। আপনারা একটুও শব্দ করবেন না, সবাই মনে মনে আল্লাহকে ডাকেন।