হুঁ! সফদর আলী চোখ নাচিয়ে বললেন, এত অবাক হচ্ছেন কেন, ব্যাপারটা কঠিন কিছু নয়, একটু সময় লাগে আর কী!
আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না সফদর আলী আমার সাথে ঠাট্টা করছেন কিনা। এমনিতে অবশ্যি তিনি ঠাট্টা-তামাশার মানুষ নন, কিন্তু তাই বলে গিনিপিগ রান্না করছে সেটা বিশ্বাস করি কী ভাবে? সফদর আলী আমার অবিশ্বাসের দৃষ্টি দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কম্পিউটারে অনেক কঠিন কঠিন সমস্যার সমাধান হয় কি-না?
আমি মাথা নাড়লাম, হয়।
কী ভাবে হয়?
আমি জানতাম না, তাই চুপ করে থাকলাম। সফদর আলী আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, কম্পিউটার কখনোই একটা কঠিন সমস্যা একবারে করে না। সেটাকে আগে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে দেয়া হয়, তাকে বলে প্রোগ্রাম করা। প্রত্যেকটি ছোট ছোট অংশ আলাদা আলাদাভাবে খুব সহজ। কিন্তু সবগুলো একত্র হয়ে একটি জটিল সমস্যার সমাধান হয়। রান্না করার ব্যাপারটাও তাই, পুরো রান্না ব্যাপারটা অনেক কঠিন, কিন্তু রান্না করাকে যদি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে ফেলা হয়, তা হলে সেই ছোট অংশগুলো কিন্তু মোটেও কঠিন নয়, যেমন একটা ডেকচি চুলোর উপরে রাখা বা ডেকচিতে খানিকটা ঘি ঢালা বা ঘি-এর মাঝে তেজপাতা ছেড়ে দেয়া—এই ছোট ছোট কাজগুলো যে কেউ করতে পারবে, একটু কষ্ট করে গিনিপিগকে শিখিয়ে দিলে একটা গিনিপিগও করতে পারবে।
সফদর আলী থামলেন। আর আমার মনে হল আমি খানিকটা বুঝতে পারছি তিনি কী ভাবে গিনিপিগকে দিয়ে রান্না করিয়ে নিচ্ছেন। আমার তখনো পুরোপুরি বিশ্বাস হয় নি, তাই সফদর আলী আবার শুরু করলেন, আমি করেছি কী, অনেকগুলো গিনিপিগকে নিয়ে তাদের প্রত্যেকটিকে আলাদা আলাদা জিনিস করতে শিখিয়েছি। যেমন একটা গিনিপিগ একটা ডেকচি ঠেলে চুলোর ওপরে তুলে দেয়, সে আর কিছুই পারে না। যখনই একটা ঘন্টা বাজে তখনই সে ঠেলে ঠেলে একটা ডেকচি চুলোর উপরে তুলে দেয়। সেটা শেখানো এমন কিছু কঠিন না—দু’দিন এক ঘন্টা করে শেখাতেই শিখে গেল। এর পরের গিনিপিগটা শুধু চুলোটা জ্বালিয়ে দেয়, সেটা শেখানো একটু কঠিন হয়েছিল, প্রথম প্রথম লোম পুড়ে যেত, এখন সাবধান হয়ে গেছে, আর লোম পোড়ে না। চুলো ধরে যাবার পর তিন নম্বর গিনিপিগটা এসে ডেকচিতে খানিকটা ঘি ঢেলে দেয়, তার পরই তার ছুটি! এরকম সব মিলিয়ে চিচিংগাইশটা গিনিপিগ আছে—
আমি বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, চিচিংগাইশ মানে কি?
ও, চিচিংগাইশ হচ্ছে দুই আর কিলি, তার মানে যোল দু’গুণে বত্রিশ যোগ কিলি, তার মানে আপনাদের তেতাল্লিশ! যাই হোক এই তেতাল্লিশটা গিনিপিগ তেতাল্লিশটা ভিন্ন ভিন্ন ছোট ছোট কাজ করে, সবগুলো যখন শেষ হয় তখন চমৎকার এক ডেকচি বিরিয়ানি রান্না হয়ে যায়। সফদর আলী কথা শেষ করে একটু হাসলেন।
কিন্তু যদি গিনিপিগগুলো উল্টোপাল্টা করে ফেলে, ঘি গরম হবার আগেই যদি চাল ঢেলে দেয়?
করবে না, এক জন শেষ করার আগে আরেকজন শুরু করবে না। প্রথম গিনিপিগ তার কাজ শেষ করে দ্বিতীয়টার পেটে একটা খোঁচা দেয়, এই খোঁচা না খাওয়া পর্যন্ত দ্বিতীয়টা তার কাজ শুরু করবে না। সব ট্রেনিং দেয়া আছে।
আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না। সফদর আলী যেটা বলেছেন, সেটা অসম্ভব হয়তো নয়, কিন্তু তাই বলে তেতাল্লিশটা গিনিপিগ হৈচৈ করে কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করছে, দৃশ্যটা কল্পনা করতেই আমার অস্বস্তি হচ্ছিল।
আমার অবিশ্বাসের ভঙ্গি দেখে সফদর আলী বললেন, আপনার বিশ্বাস হল না? আচ্ছা, আপনাকে দেখাচ্ছি। এই বলে তিনি বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে লেজ ধরে একটা নেংটি ইঁদুর বের করলেন, আমার বরাবরই সন্দেহ ছিল সফদর আলী পকেটে করে জ্যান্ত কিছু নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! ইঁদুরটা টেবিলে রাখামাত্র পাশের টেবিলের এক জন চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল, সে ভেবেছে খাবার থেকে ইঁদুর বেরিয়েছে। অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করা হল, কিন্তু সফদর আলী আমাকে আর দেখাতে পারলেন না, ইঁদুরটা পকেটে ঢুকিয়ে বললেন পরদিন বিকালে তাঁর বাসায় যেতে। আমাকে গিনিপিগের বিরিয়ানি রান্না দেখাবেন।
পরদিন অফিসে গিয়ে শুনলাম জরুরি কাজে আমাকে তক্ষুনি চট্টগ্রাম যেতে হবে। আমাদের কোম্পানির এক জন ম্যানেজার নাকি অনেক টাকা নিয়ে সরে পড়েছে। আমাকে অফিস থেকে সোজা এয়ারপোর্ট যেতে হল, বাসায় এক জন খবর পৌঁছে দেবে। ভেবেছিলাম দু’তিন দিন লাগবে, কিন্তু সেই ম্যানেজার এমনই ঝামেলা করে রেখেছিল যে পুরো দুই সপ্তাহ লেগে গেল। ঢাকায় ফিরে এসে ভাবলাম, সফদর আলীর সাথে দেখা করি। কিন্তু অফিসে ছিলাম না বলে এত কাজ জমে গিয়েছিল যে সময় পেতে পেতে আরো এক সপ্তাহ কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত সময় করে সফদর আলীর বাসায় গিয়ে তাঁকে পেলাম না। বেল টিপতেই কুকুরটা এমন ভয়ানক ঘেউ ঘেউ করা শুরু করল যে আমি আর অপেক্ষা করার সাহস পেলাম না। জিলিপির দোকানে খোঁজ নিয়ে জানলাম, সফদর আলী অনেকদিন হল সেখানে আর যান না। পরে কয়েকবার তাঁর বাসায় গিয়েছি, তাঁর দরজায় চিঠি লিখে ঠিকানা দিয়ে এসেছি, কিন্তু তিনি আর যোগাযোগ করেন নি। আমাকে কয়েকদিনের ভেতরে আবার খুলনা যেতে হল, সেখানকার ম্যানেজারও নাকি কিছু টাকা নিয়ে সরে পড়েছে। খুলনা থেকে গেলাম রাজশাহী, সেখান থেকে বগুড়া হয়ে ঢাকা। ঢাকায় ফিরে এসেও প্রথম-প্রথম অনেক ব্যস্ত ছিলাম, সপ্তাহখানেক পরে খানিকটা সময় পেয়ে ভাবলাম, সফদর আলীর বাসা থেকে ঘুরে আসি।