আমি সফদর আলীকে সবকিছু খুলে বললাম, শুনে তিনি খুব অবাক হলেন বলে মনে হল না। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, যে চৌকিতে তাকে শশাওয়ানো হয় সেখানে পেরেকের সংখ্যা কত?
অনেক, গুনে তো দেখি নি।
তবু, আন্দাজ?
এক আঙুল পরপর হবে, পাঁচ ছয় শ’ কী এক হাজার!
সফদর আলী মাথা নেড়ে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে কী একটা হিসেব করলেন। তারপর মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলেন, পীর সাহেবের বুকের উপর যে-ইটটাকে হাতুড়ি দিয়ে মারা হয়, সেটা ভেঙে যায় তো?
হ্যাঁ।
কয় টুকরা হয়?
অনেক, গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়।
সফদর আলী আরো কিছুক্ষণ কী একটা হিসেব করে বললেন, যখন গনগনে কয়লার উপর দিয়ে হাঁটে, তখন কি আস্তে আস্তে হাঁটে না তাড়াতাড়ি?
তাড়াতাড়ি, বেশ তাড়াতাড়ি।
হাঁটার আগে কি পা পানিতে ভিজিয়ে নেয়?
আমি মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করি। পা ভিজিয়ে নেয়ার কথা মনে নেই, কিন্তু মনে হল সাগরেদরা তাকে ওজু করিয়ে দেয়। শুনে সফদর আলী একটু হাসলেন, পকেট থেকে কী একটা ছোট বই বের করে সেখান থেকে কী সব টুকে নিয়ে কী একটা হিসেব করে হঠাৎ খিকখিক করে হাসতে থাকেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?
ব্যাটা এক নম্বর চোর।
কে?
আপনার পীর বাবা।
কেন?
এই দেখেন। সফদর আলী তাঁর নোটবইটা দেখালেন, সেখানে অনেকরকম হিসেব, নিচে এক জায়গায় লেখা, (২০০ + ১০০০) x ২ = চোর (৬০০ + ১০,০০০) + ১০০ = মহাচোর।
আমি খানিকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকি। এরকম অঙ্ক কষে চোর মহাচোর বের করতে দেখা এই প্রথম। সফদর আলীর দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই তিনি বললেন, বুঝতে পারলেন না? ঠিক আছে, বুঝিয়ে দিই।
সফদর আলীর বেশ কিছুক্ষণ লাগল আমাকে বোঝাতে। মাথাটা বরাবরই আমার একটু মোটা। এসব জিনিস বুঝতে আমার একটু সময় লাগে। কিন্তু এক বার বুঝিয়ে দেয়ার পর আমারও কোনো সন্দেহ থাকে না যে, পীর বাবা আসলে একটা চোর ছাড়া আর কিছু নয়। ব্যাপারটি এরকম, এক জন মানুষের ওজন খুব বেশি হলে হয়তো দেড় শ’ পাউন্ড হয়, আমাদের পীর বাবার কথা অবশ্যি আলাদা। ঘি-মাখন খেয়ে দু শ’ পাউন্ডের এক ছটাক কম নয়। তিনি যখন সুচালো পেরেকের বিছানার উপর শুয়ে থাকেন, তখন এই পুরো ওজনটি প্রায় হাজার খানেক পেরেকের উপর ভাগ হয়ে যায়। পুরো ওজনটি যদি একটি মাত্র পেরেকের ওপর দেয়া হত, পেরেকটি সাথে সাথে শরীর ফুটো করে ঢুকে যেত, কিন্তু সেটি কখনন করা হয় না। হাজারখানেক সুচালো পেরেককে দেখতে ভয় লাগে ঠিকই, কিন্তু একেকটি পেরেকে মাত্র কয়েক আউন্স করে চাপ পড়ে। সেটি কিছুই নয়। যে কোনো মানুষ একটি পেরেকের মাথায় কয়েক আউন্সের চাপ সহ্য করতে পারে, এমনকি ঘি-দুধ-খাওয়া পীরসাহেব পর্যন্ত। বুকের উপর থান ইট ভেঙে ফেলা ব্যাপারটি শুধু দেখতেই ভয়ংকর, আসলে কিছু না, হাতুড়ি দিয়ে ঘা মেরে যেটুকু শক্তি প্রয়োগ করা হয়, তার বেশিরভাগই খরচ হয়ে যায় ইটটাকে ভাঙতে। বাকিটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে পেরেকের উপরে চাপ আরো আউন্সখানেক বাড়িয়ে দেয়, সেটা এমন কিছু নয়। গনগনে কয়লার উপরে হাঁটা ব্যাপারটা একটু জটিল, একটু বিপজ্জনকও। জ্বলন্ত কয়লার তাপমাত্রা ছয় সাত শ’ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, সেটা ঠাট্টার ব্যাপার নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে জিনিসটা কয়লা। কয়লার ওজন কম। কাজেই এর তাপ ধারণ করার ক্ষমতাও কম। কাজেই কেউ যদি জ্বলন্ত কয়লার উপরে চাপ দেয়, খুব বেশি তাপ পায়ে এসে পৌঁছাতে পারে না। কয়লা পা-কে পোড়ানোর আগেই পা কয়লাকে ঠাণ্ডা করে দেয়। কয়লার ভিতরের তাপ পা পর্যন্ত পৌঁছুতে একটু সময় লাগে, কিন্তু খুব দ্রুত হেঁটে গিয়ে সেই সময়টুকুও কয়লাকে দেয়া হয় না। তা ছাড়া যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে পা পানিতে ভিজিয়ে নেয়া। তাই যখন জ্বলন্ত কয়লায় পা দেয়া হয়, পায়ের তলার পানি বাষ্পীভূত হয়ে পায়ের তলায় বাষ্পের একটা খুব সূক্ষ্ম আস্তরণ তৈরি করে ফেলে। বাষ্পের আস্তরণ, সেটা যত সূক্ষ্মই হোক, তার ভিতর দিয়ে তাপ খুব ভালোভাবে যেতে পারে না। সফদর আলী ব্যাপারটাকে হাতে-কলমে দেখালেন। চায়ের দোকানের দোকানি তখন সিঙাড়া ভাজার জন্যে কড়াইটা গরম করছিল, বেশ গনগনে গরম কড়াই, সফদর আলী তার উপর কয়েক ফোঁটা পানি ফেলে দিলেন। সেগুলো সাথে সাথে বাষ্পীভূত না হয়ে খানিকক্ষণ কড়াইয়ের উপর দৌড়ে বেড়াল। পানির ফোঁটার নিচে বাম্প, তাপ সেই বাষ্পের আস্তরণ ভেদ করে পানিতে পৌঁছাতে পারছে না বলে পানি বাষ্পীভূত হচ্ছে না। ভারি মজার ব্যাপার।
সফদর আলীর ব্যাখ্যা শুনে আমার আনন্দে নাচতে ইচ্ছা করে, সারা জীবন বিশ্বাস। করে এসেছি পৃথিবীতে অলৌকিক বা ব্যাখ্যার অতীত কিছু নেই। সেই বিশ্বাস ছেড়ে দিতে হলে খুব দুঃখের ব্যাপার হত। আমার আনন্দের বড় কারণটা অবশ্যি অন্য একটি ব্যাপার। সফদর আলীর এরকম বিজ্ঞানী মাথা, তিনি যখন এত সহজে ব্যাপারটি ধরে ফেলতে পারলেন, আরো সহজে হয়তো এমন একটা বুদ্ধি বের করতে পারবেন যে জোচ্চোর পীরকে হাতেনাতে ধরে ফেলা যাবে।
সফদর আলীকে সে কথাটি বলতেই তিনি প্রায় আঁৎকে উঠলেন। বললেন, না না, সে কী করে হয়?
কেন? বয়স্ক একটা মানুষকে এভাবে লজ্জা দেয়া ঠিক না।
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ব্যাটা জোচ্চোর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে দশজন নিরীহ মানুষের মাথা ভেঙে খাচ্ছে, সেটা দোষ নয়, আর তাকে ধরিয়ে দেয়া দোষ?