দেখলাম হুঁজুর খাড়া পেরেকের উপর ভেসে আছেন, চোখ বন্ধ। কিন্তু মুখে হাসি। পেরেকের বিছানা না, যেন গদির বিছানা।
আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?
সুলতান সাহেব তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলেন, কী বলছি এতক্ষণ? নিজের চোখে দুই হাত দূরে বসে দেখেছি। দুই হাতের এক ইঞ্চি বেশি নয়।
আজিজ খা বললেন গল্পটা শেষ করেন, আসল ব্যাপারটাই তো এখনো বললেন না।
সুলতান সাহেব মুখে একটা আলগা গাম্ভীর্য নিয়ে এলেন, অবিশ্বাসী মানুষকে বলে লাভ কি? যার বিশ্বাস হবে না, খোদা তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেও বিশ্বাস হবে না।
তবু বলেন।
সুলতান সাহেব আমার দিকে তাকালেন, শুনতে চান?
বলেন, শুনি।
শোনেন তাহলে। যখন দেখলাম হুঁজুর সেই পেরেকের বিছানায় শুয়ে আছেন, আমার তখন হুঁজুরের ক্ষমতার উপরে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনার মতো একজন দু’জন মানুষ কি আর নেই? তাদের ভেতরে তো সন্দেহ থাকে। তাদের সন্দেহ মেটানোর জন্যে এক জন সাগরেদ একটা বড় তক্তা নিয়ে এসে হুঁজুরের বুকের উপর রাখলেন। তার উপরে রাখলেন দুইটা থান ইট, দেখে ভয়ে তো আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। ঘটনাটা মনে করে সুলতান সাহেব সত্যি দম বন্ধ করে ফেললেন।
বলুন, বলুন, অন্যেরা সুলতান সাহেবকে থামতে দেন না।
হুজুরের বুকের উপর ইট রেখে সাগরেদ নিয়ে এল একটা মস্ত হাতুড়ি। কিছু বোঝার আগে হাতুড়ি তুলে দিল হুঁজুরের বুকে প্রচণ্ড এক ঘা। ইট দুইটা ভেঙে টুকরা-টুকরা, হুঁজুর কিছু জানেন না, চোখ বন্ধ করে জিকির করে যাচ্ছেন।
সমবেত শ্রোতাদের বুকের ভেতর থেকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। সুলতান সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন আপনি কী বলতে চান?
মাথা চুলকে বললাম, নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত—
তার মানে আপনি বলতে চান আমি মিথ্যা কথা বলছি?
না না, তা বলছি না। যেহেতু আপনার এত বিশ্বাস, হয়তো অনেক খুঁটিনাটি জিনিস আপনার চোখে পড়ে নি, নিজের চোখে দেখলে বুঝতে পারব।
মাওলা সাহেব বললেন, তার মানে আপনি বলছেন এটা বুজরুকি?
নিজে না দেখে কিছু বলব না। অবিশ্বাস্য জিনিস দেখলেই সেটা বিশ্বাস করা ঠিক। ম্যাজিশিয়ানরা মানুষ কেটে জোড়া লাগিয়ে ফেলে। তার মানে কি ম্যাজিশিয়ানরা পীর?
অফিসের সবাই এমনভাবে আমার দিকে তাকাল, যে, তাদের ভেতর যদি বিন্দুমাত্র ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকত, আমি ভস্ম হয়ে যেতাম।
পরের কয়দিন আমি নিয়মিত সেই পীরের আস্তানায় যাওয়া শুরু করলাম। অবিশ্বাস্য হলেও সুলতান সাহেব এতটুকু বাড়িয়ে বলেন নি। সত্যি সত্যি সেই পীর সুচালো পেরেকের উপরে শুয়ে থাকেন। সাগরেদরা বুকে থান ইট ভেঙে টুকরা-টুকরা করে ফেলেন, পীরের কোনোরকম অসুবিধে হয় না। শুধু তাই নয়, একদিন দেখি বড় বড় কাঠের টুকরা পুড়িয়ে গনগনে আগুন করা হল, সাগরেদরা কোনোভাবে সেই পীরকে আগুনের উপর দাঁড় করিয়ে দিল, পীর খালিপায়ে ঐ আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে গেলেন, অবিশ্বাস্য ব্যাপার, নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না। অনেকের সাথে সাথে আমিও পীরের পায়ের তলা দেখে এসেছি, ফোস্কা দূরে থাকুক, একটু চিহ্ন পর্যন্ত নেই। দেখে শুনে আমিও হতবাক হয়ে যাই, বিশ্বাসও প্রায় করে ফেলেছিলাম, কিন্তু শেষ অংশটুকু এখনো কোথায় জানি সন্দেহ জাগিয়ে রেখেছে। প্রতি রাতের একই ব্যাপার। সবকিছু শেষ হয়ে গেলে পীর আধা বেহুশ হয়ে একটা গদিতে পড়ে থাকেন, তখন ভক্তেরা একে একে আসতে থাকে, পীর বাবার পা ধরে নিজেদের দুঃখ-কষ্ট-সমস্যার কথা বলে যায়। পীর বাবা কাউকে একটা লাথি দেন, কাউকে একটু চাল পড়া দেন, কাউকে এক টুকরো কয়লা, আবার কারো জন্যে একটু দোয়া করে দেন। ভক্তেরা হুঁজুরের পায়ের কাছে বড় গামলাতে সামর্থ্যমতো টাকাপয়সা ফেলে যায়। হুঁজুর এবং তাঁর সাগরেদরা আড়চোখে দেখেন কে কত টাকা দিল। টাকার অঙ্ক বেশি হলেই তাদের মুখের হাসিটি বিস্তৃত হয়ে ওঠে, ভক্তের খাতির-যত্নও হয় বেশি, পীর বাবা লাথি না দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। দেখতে-দেখতে গামলা ভরে ওঠে টাকায়। প্রতি রাতে অন্তত হাজারখানেক টাকা কিংবা আরো বেশি। এইখানেই আমার সন্দেহ, ঐশ্বরিক ব্যাপারের সাথে সাথে টাকাপয়সার ব্যাপারটি ঠিক খাপ খায় না সত্যিকারের সিদ্ধপুরুষের টাকাপয়সার কী দরকার?
অফিসে যারা হযরত শাহ্ খবিবুল্লাহ্ কুতুবপুরী এবং হযরত নূরে নাওয়াজ নকশবন্দীর মুরীদ ছিলেন, তাঁরা সবাই এখন এই নতুন পীর হামলা বাবা বিক্রমপুরীর মুরীদ হয়ে গেলেন। সুলতান সাহেবের দীর্ঘদিন থেকে অম্বলের ভাব, সেদিন পীর সাহেবের চাল-পড়া খাবার পর থেকে নাকি চোঁকা ঢেকুরের সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। মাওলা সাহেবের পিঠে ব্যথা, সেদিন হামলাবাবার একটা লাথি খাওয়ার পর থেকে ব্যথার কোনো চিহ্ন নেই। আজিজ খায়ের ছোট ছেলের হুঁপিং কাশ, বাবার তেল-পড়া বুকে মাখিয়ে দেয়ার পর থেকে কাশির কোনো চিহ্ন নেই। প্রতিদিনই এরকম নতুন নতুন ঘটনা শুনতে থাকি। এবারে আর শোনা ঘটনা নয়, সব চাক্ষুষ ঘটনা। অফিসের বিশ্বাসী লোকজনের খোঁচায় আমার অফিসে কাজ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। অবস্থাচক্রে মনে হয় আর কয়দিন দেখে-শুনে আমিও হয়তো হামলা বাবার পা চেপে ধরে মুরীদ হয়ে যাব।
চায়ের দোকানে সফদর আলীর সাথে আমি সে কথাটাই বলছিলাম। অলৌকিক কিছু হতে পারে না, আজীবন বিশ্বাস করে এসেছি, এখন হঠাৎ চোখের সামনে এরকম অবিশ্বাস্য জিনিস দেখে মানুষের ক্ষমতাকে অবিশ্বাস করি কেমন করে? হয়তো সুলতান সাহেবের কথাই ঠিক, মানুষ হয়তো দীর্ঘদিন তপস্যা করে সত্যি সত্যি অলৌকিক শক্তি অর্জন করে ফেলে।