তা নির্ভর করে আপনি দুষ্টু লোক বলতে কী বোঝান তার ওপর। তবে হ্যাঁ, যারা লোক ঠকায় তারা দুষ্টু লোক ছাড়া আবার কী?
সবাই লোক ঠকায়?
আপনি কোনো গরিব পীর দেখেছেন? দেখেন নি—কারণ গরিব পীর নেই। যে-পীরের যত নামডাক সেই পীরের তত বেশি টাকাপয়সা, টাকাপয়সাটা আসে কোথা থেকে? পীরদের কখনো তো চাকরিবাকরি করতে দেখি না।
তার মানে আসলে সত্যিকার কোনো পীর নেই?
নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তারা কখনো চাইবে না লোকজন তাদের কথা জেনে ফেলুক, কাজেই তাদের দেখা পাওয়া মুশকিল।
সফদর আলী চিন্তিত মুখে চুপ করে থাকেন।
সৌভাগ্যক্রমে অফিসে পীরসংক্রান্ত উচ্ছ্বাস চরমে ওঠে, তারপর আস্তে আস্তে ভাটা পড়তে শুরু করে। সবকিছুরই এরকম নিয়ম, এক জিনিস নিয়ে আর কত দিন থাকা, যায়? যারা পীরদের কাছে যায় সবারই কোনো-না-কোনো সমস্যা থাকে, প্রথম প্রথম তাদের প্রবল বিশ্বাস থাকে যে পীর তাদের সমস্যার সমাধান করে দেবেন। পীর কখনোই সমস্যার সমাধান করতে পারেন না। তীব্র বিশ্বাস নিয়ে তবু মুরীদেরা কিছুদিন ঝুলে থাকে। তারপর একসময় উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়ে আসে। এবারেও তাই, আমি দেখতে পাই হযরত খবিবুল্লাহ্ কুতুবপুরী এবং হযরত নুরে নাওয়াজ নকশবন্দীর মুরীদদের উচ্ছাস আস্তে আস্তে কমতে থাকে। তাই একদিন ভোরে অফিসে এসে যখন দেখতে পাই যোগ ব্যায়ামের মাহাত্ম দেখানোর জন্যে সেকশান অফিসার ইদরিস সাহেব ছোট একটা হাফ প্যান্ট পরে খালি গায়ে মেঝেতে শুয়ে আছেন, আর লিকলিকে আকমল সাহেব তাঁর পেটের ওপর খালি পায়ে লাফাচ্ছেন, আমার বেশ ভালোই লাগল। পীর-ফকিরের ওপর অন্ধবিশ্বাস থেকে কোনো একটা কিছু প্রমাণ করার জন্যে হাতে-কলমে চেষ্টা করা অনেক ভালো।
ধীরে ধীরে অফিসটা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছিল, মোহররমের মাসটা পর্যন্ত চাঁদা না দিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছিলাম কিন্তু তার মাঝে গোলমাল বেধে গেল, সত্যি কথা বলতে কি বেশ বড় গোলমাল। একদিন ভোরে অফিসে এসে দেখি টাইপিস্ট সুলতান সাহেবের টেবিল ঘিরে একটা ভিড়। ভিড় দেখলে আমি যোগ না দিয়ে পারি না। এবারেও ভিড়ে গেলাম। সুলতান সাহেব একজন নতুন পীরের খোঁজ এনেছেন। এই পীরের অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সুলতান সাহেবের বড় ভাই নিজের চোখে দেখে এসেছেন। এই পীর নাকি জিকির করতে-করতে একসময় বেশ হয়ে পড়েন। তাঁর আত্মা তখন উচ্চমার্গে চলে যায় এবং সারা শরীর থেকে চল্লিশ ওয়াট বাবের মতো আলো বের হতে থাকে। এরকম অবস্থায় তিনি সবরকম ব্যথা-বেদনার উর্ধ্বে চলে যান, তখন তাঁকে আগুনের উপর ফেলে দিলে তিনি টের পান না। চাকু দিয়ে আঘাত করলে চাকু পিছলে যায়। দা দিয়ে কোপ দিলে দা ছিটকে আসে—তাঁর কিছু হয় না। আধঘন্টা তাঁকে আগুনের ভেতর ফেলে রাখা হয়েছিল। যখন আগুন নিভে গেল, দেখা গেল চোখ বন্ধ করে মুখে হাসি নিয়ে জিকির করছেন।
সুলতান সাহেবের গল্প শেষ হতেই সবাই আমার মুখের দিকে তাকায়। এত দিনে সবাই জেনে গেছে আমি অবিশ্বাসী। ওয়ালী সাহেব বলেন, কিন্তু আপনি যে সবসময় অবিশ্বাস করেন, এখন কী বলবেন?
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, ওসব গালগল্পে কান দেবেন না। সুলতান সাহেব যদি নিজের চোখে দেখে আসতেন, তবু একটা কথা ছিল।
সুলতান সাহেব রেগে প্রায় লাফিয়ে ওঠেন, তার মানে আপনি বলতে চান আমার বড় ভাই মিথ্যা কথা বলেছেন?
ঝগড়া লেগে যাবার মত অবস্থা, আমি তাড়াতাড়ি নিজের টেবিলে ফিরে আসি।
পরদিন ভোরে অফিসে ঢোকার আগেই সবাই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সুলতান সাহেব সবার আগে। হুঁঙ্কার দিয়ে বললেন, এখন কী বলবেন?
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
বলছিলেন আমার ভাইয়ের কথা বিশ্বাস করেন না, এখন কী বলবেন? কাল আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি।
আমি সত্যি সত্যি অবাক হলাম, এসব অলৌকিক জিনিস কেউ নিজের চোখে দেখে এসেছে, সেরকম ঘটনা বিরল। জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখেছেন?
সুলতান সাহেব উৎসাহে টগবগ করতে থাকেন, আপনাদের মতো অবিশ্বাসীরা বিশ্বাস করল কি না করল তাতে কী আসে যায়? কিছু আসে যায় না।
আমি বললাম, তবু শুনি।
আমি গিয়েছি সন্ধ্যার পর, হাজার লোক, তার সামনে বসে হুঁজুর জিকির করছেন। এক ঘন্টা জিকির করলেন, তারপর, হঠাৎ বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। হাত-পা থরথর করে কাঁপতে থাকে-দশজন মিলে ধরে রাখা যায় না। চোখে-মুখে কেমন একটা আলো আলো ভাব। কোনোরকম ব্যথা-বেদনা নেই—কথা বলতে-বলতে সুলতান সাহেবের চোখ-মুখ থেকেই কেমন একটা আলো বের হতে থাকে।
আমি মাথা চুলকে বললাম, কী ভাবে বুঝলেন, ব্যথা-বেদনা নেই?
সুলতান সাহেবের মুখ আমার প্রতি অবজ্ঞায় বেঁকে যায়। মুখটা বাঁকা রেখেই বললেন, নিজের চোখে দেখুন এবার, ভাইয়ের কথা তো বিশ্বাস করলেন না, ফিরিশতার মতো বড় ভাই আমার। যখন হুঁজুর বেহুশ হয়ে গেলেন তখন একটা বড় চৌকি আনা হল। চৌকির ওপরে কী জানেন?
কি?
পেরেক। ছয় ইঞ্চি পেরেক। খাড়া হয়ে আছে—একটা নয়, দুইটা নয়, শত শত পেরেক, দেখলে ভয়ে দম বন্ধ হয়ে যায়। হুঁজুরের সাগরেদরা হুঁজুরকে তুলে এনে সেই পেরেকের উপর ফেলে দিলে ভয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মনে হল চোখ খুললে দেখব শরীরটা মোরর মতো গেঁথে গেছে পেরেকে। রক্তারক্তি ব্যাপার। ভয়েভয়ে চোখ খুলেছি, কী দেখলাম জানেন?
সবাই এর মাঝে কয়েকবার গল্পটা শুনেছে, তবু উৎসাহের অভাব নেই, কয়েকজন একসাথে জিজ্ঞেস করলেন, কি?