কথা শেষ হওয়ার আগেই লিকলিকে শরীর নিয়ে আকমল সাহেব আজিজ খাঁয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রচণ্ড হাতাহাতি শুরু হওয়ার অবস্থা, আমরা টেনে সরিয়ে রাখতে পারি না।
সেই থেকে আকমল সাহেব আর আজিজ খাঁয়ের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কিন্তু খবর ছড়িয়ে গেল দ্রুত। আজিজ খায়ের মতো লোকেরও নিজের পীর আছে। শুধু তাই নয়, সেই পীর নাকি হযরত শাহ্ খবিবুল্লাহ্ কুতুবপুরীর দাড়ি দিয়ে পা পর্যন্ত মোছেন না। লোকজন খবর নিতে আসে। স্বল্পভাষী আজিজ খাঁ বলবেন না বলবেন না করেও একটা দুটো কথা বলে ফেলেন। শুনে সবার ভিরমি লেগে যায়। একটি গল্প এরকম : আঠার বছরের মেয়েকে নিয়ে মা এসেছেন পীরের কাছে। দুই বছর থেকে সেই মেয়ের ওপর জিনের আছর। মেয়ে পীরকে দেখে আর এগুতে চায় না, কারণ সহজ, মেয়ে তো আসলে মেয়ে নয়, তাকে চালাচ্ছে এক কাফির জিন, জিনদের ভেতরেও নামাজী এবং কাফির জিন আছে। পীর খালি একবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর এক হাত সুতা নিয়ে বসলেন। একটা করে সুরা পড়েন আর সুতায় একটা করে গিট দেন, সাথে সাথে জিনের সে কী চিল্কার! বলে, বাবাগো, মাগো, ছেড়ে দাও, সুলায়মান পয়গম্বরের কসম আমাকে ছেড়ে দাও। পীর বললেন, শালার ব্যাটা, তুই এখনি দূর হয়ে যা। তখন জিন আর যেতে চায় না, হুঁজুরের সাথে তখন কী ভয়ংকর ঝগড়া! কিন্তু হুঁজুরের সাথে পারবে সে সাধ্যি কার আছে? শেষ পর্যন্ত জিন যেতে রাজি হল। হুঁজুর বললেন, যাওয়ার আগে একটা চিহ্ন দিয়ে যা। জিন জিজ্ঞেস করল, কী চিহ্ন দিয়ে যাব? হুঁজুর বললেন, দরবারের সামনে আমগাছের একটা মোটা ডাল ভেঙে দিয়ে যা। মুহূর্তে মেয়ে চোখ খুলে তাকায়, আর ঝড় নেই বৃষ্টি নেই মড়মড় করে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। আজিজ খাঁ শুধু গল্প বলেই ক্ষান্ত হলেন না, ঘোষণা করলেন যারা যারা ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে চায় সামনের শুক্রবার তাদের নিয়ে যাবেন, নিজের চোখে সেই আমগাছের ভাঙা ডাল দেখে আসবে।
পরের সপ্তাহে বেশ কয়জন আজিজ খাঁর সাথে পীরের দরবার থেকে ঘুরে এলেন। আজিজ খায়ের গল্পে কোনো মিথ্যা নেই। সত্যি সত্যি দরবারের সামনে আমগাছের ভাঙা ডাল। তখন-তখনি কয়েকজন সেই পীরের মুরীদ হয়ে গেল।
এরপর অফিস দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। হযরত শাহ্ খবিবুল্লাহ্ কুতুবপুরীর মুরীদেরা এবং হযরত মাওলানা নূরে নাওয়াজ নকশবন্দীর মুরীদেরা। আমরা কয়েকজন কোনো দলেই নেই এবং আমাদের হল সবচেয়ে বিপদ। দু’দলের ওয়াজ-নসীহত, উরশ এবং মিলাদের চাঁদা দিতে দিতে ফতুর হয়ে যাবার মতো অবস্থা। এক দলকে পাঁচ টাকা চাঁদা দিলে আরেক দল দশ টাকা না নিয়ে ছাড়ে না, তখন আবার প্রথম দল এসে আরো পাঁচ টাকা নিয়ে সমান সমান করে দেয়। চাঁদা না দিয়ে উপায় নেই। এক দুই মিনিট অনুরোধ করেই হুঁমকি দেয়া শুরু হয়ে যায়। দেখে-শুনে মনে হল সবকিছু ছেড়েছুড়ে নিজেই পীর হয়ে যাই। পীর যদি হতে না পারি, অন্তত ধর্মটা পাল্টে ফেলি। অফিসে এক জন বৌদ্ধ কেরানি আছে, দিলীপকুমার বড় ময়া, তাকে কেউ কখনো বিরক্ত করে না।
সেদিন সফদর আলীর সাথে চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে পীরের উপদ্রব নিয়ে কথা হচ্ছিল। কী ভাবে দুই পীরের ভক্তেরা দলাদলি শুরু করেছেন এবং দুই দলের টানাটানিতে আমাদের কী ভাবে দম বের হয়ে যাচ্ছে, সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম।
সব শুনেটুনেও সফদর আলী ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, পীরদের কি কোনো পরীক্ষা পাস করতে হয়?
আমি হাসি গোপন করে বললাম, না।
তাহলে আপনি বুঝবেন কেমন করে যে সে পীর?
ব্যাপারটা হচ্ছে বিশ্বাস।
তাহলে আপনি কেন একজনকে বিশ্বাস করবেন, আরেকজনকে অবিশ্বাস করবেন?
আমাকে তখন সফদর আলীকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে হয়। বিশ্বাস অর্জনের জন্যে সবসময়েই পীরদের সম্পর্কে অলৌকিক কাহিনী ছড়ানো হয়। সাধারণ মানুষের অনেক সমস্যা থাকে, অলৌকিক জিনিস বিশ্বাস করতে তাদের এতটুকু দেরি হয় না। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই অলৌকিক ঘটনাগুলো কখনো কেউ যাচাই করার চেষ্টা করে না। আমি এখন পর্যন্ত একটি মানুষকেও পাই নি যে বলেছে সে নিজে একটি অলৌকিক ঘটনা দেখেছে। সবসময়েই শোনা ঘটনা, ওমুকের বড় ভাইয়ের শালা বলেছেন, ওমুকের ভায়রা ভাই নিজের চোখে দেখেছেন। ওমুক অফিসের বড় সাহেব করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এক জন দু’জন যে নিজের চোখে দেখেছেন বলে দাবি করেন নি তা নয়। কিন্তু চেপে ধরার পর সবসময়েই দেখা গেছে হয় মিথ্যে না হয় অতিরঞ্জন। একবার দুবার নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে আমি পীরদের কাছে গিয়েছি। কিন্তু সময় এবং পয়সা নষ্ট করা ছাড়া আর কোনো লাভ হয় নি।
সফদর আলীর তখনো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় না, মাথা চুলকে বললেন, তাহলে এক জন মানুষ কেন পীর হয়ে যায়?
পীরদের বাড়ি দেখেছেন কখনো?
না।
দেখলে আপনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন, পাকা দালান, ফ্রিজ, টেলিভিশন ছাড়া পীর নেই। পীরদের চেহারা দেখলে আপনি বোকা বনে যাবেন, দুধ-ঘি খেয়ে একেকজনের অন্তত আড়াই মণ ওজন এবং গায়ের রঙ গোলাপি। এই বাজারে এত আরামে কয়জন থাকতে পারে? একবার একটা ভালো পীর যদি হয়ে যেতে পারেন, কয়জন বড় পুলিশ, আর্মি অফিসারকে মুরীদ করে নিতে পারেন, আর কোনো চিন্তা নেই।
সফদর আলী চিন্তিত মুখে চুপ করে খানিকক্ষণ কী একটা ভাবলেন, তারপর বললেন, তার মানে যত পীর দেখা যায় সবাই আসলে দুষ্টু লোক?