বিচিত্র লোকজন নিয়ে বিচিত্র জায়গা এই অফিসটি। আমার বেশ লাগে। এর মধ্যে আমাদের সেকশন অফিসার মাওলা সাহেব একদিন এক পীরের মুরীদ হয়ে গেলেন। পীরের নাম হযরত শাহ্ খবিবুল্লাহ কুতুবপুরী। নামটা উচ্চারণ করার সময় গলার ভেতর থেকে আওয়াজ বের করতে হয়, আমি পাঁচ বার চেষ্টা করে মাওলা সাহেবের অনুমোদন পেলাম। মাওলা সাহেব আমাদের সামনে তাঁর পীরকে শাহে হযরত” না হয় “হুজুরে বাবা” বলে সম্বােধন করেন। প্রথম সপ্তাহ আমাদের তাঁর কাছ থেকে শুধু চেহারার বর্ণনা শুনতে হল। ছয় ফুট উঁচু, নূরানী চেহারা, গায়ের রং ধবধবে সাদা। গালের কাছে নাকি একটু গোলাপি আভা। মসলিনের মতো সাদা দাড়ি বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। মাথায় সিকের পাগড়ি। পরনে সাদা আচকান, সাদা লুঙ্গি, পায়ে জরির জুতো। হুঁজুরের দাড়ি থেকে নাকি জ্যোতির মতো আলো ছড়ায়। গলার স্বর মধুর মতো মিঠা। যখন কথা বলেন তখন গলার স্বর শুনে “দিল” ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মুরীদের সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না। কেউ বলে পাঁচ লাখ, কেউ বলে দশ লাখ, আবার কেউ বলে মাত্র পঞ্চাশ। কারণ, খাঁটি নেকবল লোক না হলে তিনি নাকি মুরীদ নেন না। হযরত শাহ্ খবিবুল্লাহ্ কুতুবপুরীর কথা বলতে বলতে মাওলা সাহেবের প্রত্যেক দিন অফিসের কাজ শুরু করতে দেরি হয়ে যায়।
প্রত্যেকদিন ভোরেই মাওলা সাহেবের কাছ থেকে আমরা হযরত শাহ্ কুতুবপুরীর খবরাখবর পেতে থাকি। একদিন শুনতে পেলাম, কোন কোম্পানির চিফ ইঞ্জিনিয়ার রুই মাছের মুড়ো খেতে গিয়ে গলায় কাঁটা বিধিয়ে ফেলেছেন। যন্ত্রণায় যখন কাটা মুরগির মতো ছটফট করছেন, তখন আত্মীয়স্বজন ধরাধরি করে শাহ কুতুবপুরীর কাছে নিয়ে এল। শাহ্ কুতুবপুরী গলায় হাত দিয়ে বললেন, কোথায় তোর মাছের কাঁটা? চিফ ইঞ্জিনিয়ার কথা বলতে গিয়ে কেশে ফেললেন। ছয় ইঞ্চি লম্বা মাছের কাঁটা বের হয়ে এল কাশির সাথে। বিশ্বাস না হলে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে গিয়ে দেখে আসা যায়। চিফ ইঞ্জিনিয়ারের বউ নাকি সেই কাঁটা ফ্রেম করে ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রেখেছেন।
মাছের কাঁটার গল্প পুরানো হওয়ার আগেই মাওলা সাহেব নতুন একটা ঘটনা শুনিয়ে দেন। স্বামী বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে ছয় বছর আগে। স্ত্রীর আহার নেই, নিদ্রা নেই, শাহ কুতুবপুরীর পায়ে এসে পড়ল একদিন। বলল, বাবা, আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দেন। শাহ কুতুবপুরী বললেন, মা, হায়াত-মউত খোদার হাতে, তবে তোর স্বামী যদি জিন্দা থাকে, তাকে তুই দেখবি। শাহ কুতুবপুরী তখন চোখ বন্ধ করে সমাধিস্থ হয়ে গেলেন। মিনিটখানেক পর শুধু হুঁ-উ-উ-উ-উ-ক করে একটা হুঁঙ্কার শোনা যায়। দুই ঘন্টা পর চোখ খুললেন কুতুবপুরী। ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে। বললেন, যা, তোর কোনো ভয় নেই, তোর স্বামী জিন্দা আছে। এক কাফির তাকে জাদু করে রেখেছিল পাহাড়ের উপর, হুঁজুর তাকে জাদু কেটে মুক্ত করে দিয়েছেন। সে রওনা দিয়েছে এদিকে। কাল ভোরে এসে পৌঁছে যাবে। পরদিন লোকে লোকারণ্য, তার মাঝে দেখা গেল ছয় বছর পর স্বামী ফিরে আসছে। বড় বড় চুল, বড় বড় দাড়ি, বড়বড় নখ। নাপিত চুল-দাড়ি কেটে দিতেই আগের চেহারা।
মাওলা সাহেব নিজের চোখে দেখেন নি, কিন্তু হুঁজুরের বড় সাগরেদের কাছে শোনা, ফিরিশতার মতো লোক, তাঁকে অবিশ্বাস করেন কেমন করে?
বেশ চলছিল এভাবে, কিন্তু আস্তে-আস্তে গোলমাল বেধে যাওয়ার উপক্রম হল। ব্যাপারটি শুরু হল এভাবে, মাওলা সাহেবের দৈনন্দিন বক্তৃতা শুনে শুনে আমাদের ছোট কেরানি আকমল সাহেব একদিন শাহ্ কুতুবপুরীর মুরীদ হয়ে গেলেন। পীরের মুরীদ হওয়ার অনেক সুবিধে, পীর নাকি তখন পরকালের বড় বড় দায়িত্বগুলো নিয়ে নেন। আকমল সাহেবের জন্যে এটা কল্পনার বাইরে, তিনি এমন নিষ্কর্মা মানুষ যে, পরকাল দূরে থাকুক, ইহকালের কোনো দায়িত্ব তাঁকে দেয়া যায় না। দুষ্ট লোকেরা বলে, আকমল সাহেব নাকি প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সিকি-আধুলি পর্যন্ত ঘুষ হিসেবে নিয়ে নেন। আকমল সাহেব মুরীদ হওয়ার পর অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হয়। তাঁর দেখাদেখি আরো কয়েকজন শাহ কুতুবপুরীর মুরীদ হয়ে গেলেন। অফিসে এখন বেশ জমজমাট একটা ধর্মীয় ভাব। পীরের দরবারের উরশ, ওয়াজ এবং মিলাদ-মাহফিলের খবরাখবর আমরা সকাল-বিকাল পেতে থাকি। পীরের মুরীদেরা তখন বেশ একটা সংঘবদ্ধ দল একসাথে বসে হুঁজুরে বাবার নামমাহাত্ম নিয়ে আহা-উহুঁ করতে থাকেন।
যাঁরা যারা তখনো পীরের মুরীদ হয়ে যান নি, তাঁদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করার জন্যে ভক্ত মুরীদেরা নানারকম চেষ্টাচরিত্র করতে থাকেন। আমাদের হেড ক্লার্ককে সে প্রসঙ্গে একদিন একটু অনুরোধ করতেই ঝামেলার সূত্রপাত। ঘটনাটি এরকম : আকমল সাহেব দুপুরে টিফিন খাবার পর হেড ক্লার্ক আজিজ খাঁকে একা একা পেয়ে বললেন, আজিজ সাহেব, এ জীবন আর কয়দিনের?
আজিজ সাহেব বললেন, অনেকদিনের। কম হলে তো বেঁচেই যেতাম।
আকমল সাহেব না শোনার ভান করে বললেন, এখন যদি আল্লাহর দিকে না যাই তাহলে কখন যাব?
আজিজ সাহেব বললেন, যাচ্ছেন না কেন? কে আপনাকে নিষেধ করছে?
আপনারা যদি আসেন জোর পাই বুকে।
আজিজ সাহেব লাল হয়ে মেঘস্বরে বললেন, কী করতে হবে আমাকে?
যদি শাহ্ কুতুবপুরীর মুরীদ হয়ে যান, আমরা মুরীদ ভাইয়েরা—
আকমল সাহেব কথা শেষ করতে পারলেন না, আজিজ খাঁ তার আগেই একেবারে ফেটে পড়লেন, ঐসব কুতুবপুরী সম্বুন্ধীপুরী আমার কাছে আনবেন না। ভণ্ড চালবাজের দল, আপনার কুতুবপুরীর দাড়ি দিয়ে আমার হুঁজুর পা পর্যন্ত মুছবেন না।