ঝামেলা। ইলেকট্রিক শক দিয়ে মেরে না ফেলে আমাদের!
না, মারতে পারবে না, ভোন্টেজ বেশি হলেও পাওয়ার খুব কম। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা চুলকে বললেন, সবগুলো যদি একসাথে আক্রমণ করে তাহলে অবশ্যি অন্য কথা।
সবগুলো তো একসাথেই আসছে। আমি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, হাতের রডটা দিয়ে দেন না কয়েকটা ঘা।
সফদর আলী লোহার রডটার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন, কাঠের হলে একটা কথা ছিল, এটা দিয়ে শক লেগে যাবে।
আমি বললাম, রুমাল দিয়ে ধরে নিন।
সফদর আলীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ঠিক বলেছেন। আমি আমার পকেট থেকে রুমালটা বের করে দিই, তিনি নিজেরটাও বের করে নেন। দুটি দিয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে লোহার রডটা ধরে সফদর আলী এক পা এগিয়ে যান। গাছগুলো হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। তারপর বেশিরভাগ সফদর আলীকে ঘিরে দাঁড়ায়। সফদর আলীও দাঁড়িয়ে পড়েন ভয়ে। একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে তিনি আরেকটু এগিয়ে যান, আর হঠাৎ গাছগুলো তার দিকে ছুটে আসে। আমি সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম, ঠিক জ্যান্ত প্রাণীর মতো গাছগুলো সফদর আলীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর চটাশ চটাশ করে সে কী ভয়ানক স্পার্ক! আমি শুনলাম, সফদর আলী একবার ডাক ছেড়ে চিৎকার করে উঠে হাতের রডটা ঘুরিয়ে এক ঘা মেরে বসলেন। একটা গাছ মনে হল কাবু হয়ে গেল। অন্যগুলো কিন্তু হাল না ছেড়ে তার পিছনে লেগে থাকে।
আমার সম্বিৎ ফিরে আসতেই তাকিয়ে দেখি, সফদর আলীকে আক্রমণ করতে গিয়ে গাছগুলো খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছে, একটা লাফ দিলে হয়তো দরজা পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারি। দেরি না করে খোদার নাম নিয়ে আমি একটা লাফ দিয়ে বসি, শেষবার লাফ দিয়েছিলাম সেই ছেলেবেলায়, কত দিনের অনভ্যাস, লুটোপুটি খেয়ে কোনোমতে দরজার কাছে গিয়ে আছড়ে পড়লাম। উঠে দাঁড়াব, হঠাৎ অনুভব করলাম আমার পিছনে কী একটা যেন আছড়ে পড়ল, সাথে-সাথে কী ভয়ানক একটা ইলেকট্রিক শক। মনে হল পায়ের নখ থেকে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত কেউ যেন ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। গোঙানোর মতো একটা শব্দ করে আরেক লাফ দিয়ে দরজার বাইরে এসে আছড়ে পড়লাম।
খানিকক্ষণ লাগল সোজা হয়ে দাঁড়াতে। গাছগুলো দরজা পার হয়ে এপাশে আসতে পারবে না। ছোট একটা কাঠের পার্টিশান আছে। গাছগাড়ির চাকা আটকে যাবে সেখানে।
ঘরের ভেতর থেকে সফদর আলীর আরেকটা চিৎকার শুনতে পেলাম। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে কোমর চেপে বসে পড়তে হল, কোথায় জানি ভীষণ লেগেছে। সেই অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে দরজার কাছে গিয়ে উঁকি দিই, সফদর আলী জানালা ধরে ঝুলে আছেন। গাছগুলো নিচে এসে জড়ো হয়ে শুড় দিয়ে তাঁকে ধরার চেষ্টা করছে। অনেক কষ্টে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ন্তুি কতক্ষণ এভাবে ঝুলে থাকতে পারবেন? কিছু একটা করতে হয়, আমি এদিকে-সেদিকে তাকিয়ে ব্যবহার করার মতো কিছু না পেয়ে একটা চেয়ার তুলে নিয়ে এগিয়ে যাই। ভেতর থেকে সফদর আলী চিঁ চিঁ করে ডাকলেন, ইকবাল সাহেব।
কি?
দৌড়ে আধসের মাংস কিনে আনুন।
মাংস? কেন?
গাছগুলোকে খাওয়াতে হবে।
ততক্ষণ ঝুলে থাকতে পারবেন?
পারতে হবে, আপনি দৌড়ান।
আমি খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়ালাম। আশেপাশে কোনো মাংসের দোকান নেই। একটা রেস্টুরেন্টে ম্যানেজারকে অনেক বুঝিয়ে রান্না করা হয় নি এরকম খানিকটা মাংস দ্বিগুণ দাম দিয়ে কিনে আবার দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরে আসি।
সফদর আলী তখনো জানালা ধরে ঝুলে আছেন। আমাকে দেখে চিঁ চিঁ করে বললেন, এতক্ষণ লাগল! দরদাম না করলে কী হত?
আমি রেগে বললাম, কে বলল আমি দরদাম করছিলাম?
সফদর আলী চিঁ চিঁ করে বলেন, সবসময় তো করেন।
আমি রাগ এবং ব্যথা দুটিই চেপে রেখে বললাম, কী করব এখন মাংসগুলো?
ছুড়ে দিন গাছগুলোর দিকে।
আমি ছুড়ে দিলাম, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ল মাংসগুলো। গাছগুলো ঘুরে গেল সাথে সাথে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মাংসের টুকরোগুলোর ওপর। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ খেলা করতে থাকে খানিকক্ষণ, তারপর চুপচাপ হয়ে যায়। গাছের পাতাগুলো আঁকড়ে ধরে মাংসের টুকরোগুলোকে।
সাবধানে জানালা থেকে নেমে আসেন সফদর আলী। গাছগুলো মাংস খেতে ব্যস্ত, তার দিকে ঘুরেও তাকাল না। সফদর আলীর দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। কোনোমতে হেটে এসে একেবারে শুয়ে পড়েন মেঝেতে। আমি খুঁজে পেতে একটা খবরের কাগজ এনে তাঁকে বাতাস করতে থাকি। আমার নিজের অবস্থাও খারাপ। একটা চোখ আবার বুজে আসছে। কুনইয়ের কাছে কোথায় জানি ছাল উঠে গেছে। প্রচণ্ড জ্বলা করছে। অনেকক্ষণ থেকে।
সফদর আলী চিঁ চিঁ করে বললেন, কাল থেকে সব গাছ মাটিতে। আর গাড়ি-ঘোড়া নয়—
আমি বললাম, কবি কি খামাখা বলেছেন—
বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে
গাছ থাকবে মাটির ওপর, গাড়িতে না ঘুরে।
সফদর আলী ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোন কবি লিখেছে এটা?
আমি উত্তর দেয়ার আগেই নিজেই বললেন, নিশ্চয়ই কবিগুরু। কবিগুরু ছাড়া এরকম খাঁটি জিনিস আর কে লিখবে?
সে-রাতে দু’হাতে ব্যান্ডেজ এবং বুজে যাওয়া চোখ নিয়ে যখন বাসায় ফিরে আসি, আমার মা দেখেই আঁৎকে ওঠেন। কী হয়েছে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলেন না। চোখে আঁচল দিয়ে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠলেন, তোরা কে কোথায় আছিস দেখে যা, কী সর্বনাশ, ছেলে আবার গুণ্ডা পিটিয়ে এসেছে গো–
আমি এবারে প্রতিবাদ পর্যন্ত করলাম না। করে কী হবে?
০৪. পীরবাবা
আমাদের অফিসটি একটি বিচিত্র জায়গা। দিনে দিনে সেটি আরো বিচিত্র হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। একদিন সকালে অফিসে এসে দেখি সেকশন অফিসার ইদরিস সাহেব খালি গায়ে একটা ছোট হাফ প্যান্ট পরে ডান পা-টা নিজের ঘাড়ের ওপর তুলে বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে একটা কৌতূহলী হোট ভিড়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম বড় সাহেবের পিঠে ব্যথা শুনে ইদরিস সাহেব এই যোগাসনটি প্রেসক্রিপশান করেছেন, প্রতিদিন ভোরে আধঘন্টা করে করতে হবে। আরেক দিন দুপুরবেলা দেখি অফিসের মাঝখানে কেরোসিনের চুলোর ওপর একটা ডেকচিতে টগবগ করে পানি ফুটছে, সেখানে মাওলা সাহেব কী—সব গাছগাছড়া ছেড়ে দিচ্ছেন। সেটি থেকে কী একট। অব্যর্থ মলম তৈরি হবে। টাকমাথায় চুল গজাতে এই মলমের নাকি কোনো তুলনা নেই। মলমটি তৈরি হচ্ছে আমাদের বৃদ্ধ অ্যাকাউন্টেন্টের জন্যে। তাঁর মাথায় বিস্তৃত টাক এবং শোনা যাচ্ছে তিনি নাকি আরেক বার বিয়ে করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছেন। প্রতিদিন ভোরে অফিস শুরু হওয়ার আগে জলিল সাহেবের কাছে কেউ-না-কেউ আসবেই। তিনি স্বপ্নের অর্থ বলে দিতে পারেন। একদিন এসে দেখি আমাদের টাইপিষ্ট মেয়েটি তাঁর সামনের চেয়ারে বসে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। সে নাকি স্বপ্নে দেখেছে তার মা সাপের কামড় খেয়ে মারা গেছে। জলিল সাহেব তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, কাঁদার কিছু হয় নি মা, মৃত্যু স্বপ্ন হচ্ছে সুখস্বপ্ন। তোমার মায়ের হায়াত দশ বছর বেড়ে গেল। শুধু মনে করার চেষ্টা কর দেখি, সাপটা কি মদ্দা ছিল না মাদী সাপ ছিল?