রিকশা করে তাঁর বাসায় পৌঁছুতে-পৌঁছুতে প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে গেল। শীতের বিকেল, রোদ পড়ে আসছে দ্রুত। বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গিয়েছে। এক সোয়েটারে শীত মানতে চায় না। সফদর আলীর বাসার সামনে দেখলাম একটা ছোটখাট ভিড়। বুঝতে অসুবিধে হল না ভিড়টি জংবাহাদুরের সৌজন্যে। লোকজনের ভিড় দেখলে জংবাহাদুর যে নিজে থেকেই খেলা দেখাতে শুরু করে, সেটা শিখেছি অনেক মূল্য দিয়ে। আজ অবশ্যি সেরকম কিছু নয়। জংবাহাদুরের মেজাজ-মরজি সুবিধের নয়, উপস্থিত লোকজনকে মাঝে-মাঝে ভেংচি কাটা ছাড়া আর কিছুতেই উৎসাহ নেই। উপস্থিত লোকজন অবশ্যি তাতেই খুশি। আমাদের দেখে সে দাঁত-মুখ খিচিয়ে কী-কী বলতে শুরু করে। বানরের ভাষা আছে কি না কে জানে, থাকলেও সেটা আমাদের জানা নেই। কাজেই জংবাহাদুর ঠিক কী বলতে চাইছে বুঝতে পারলাম না। আমরা যখন দরজা খুলে ঢুকব, তখন সে প্রবল বেগে মাথা নেড়ে নিষেধ করতে থাকে। কিন্তু বানরের কথা শুনে তো আর জগৎসংসার চলতে পারে না। আমরা তাই তালা খুলে সাবধানে ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে আবছা অন্ধকার, ভালো করে দেখা যায় না। সফদর আলী হাততালি দিতেই বাতি জ্বলে উঠল। আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, অন্ধকারে সবসময় সুইচ খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই এই ব্যবস্থা। শব্দ দিয়ে সুইচ অন করা।
ঘরের ভিতর ছড়ানো-ছিটানো জিনিসপত্র, এছাড়া আর কোনো বিশেষত্ব নেই। বোঝা যায় এটা জংবাহাদুরের ঘর। পাশের ঘরে একটু খুটখাট শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওঘরে কি ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপগুলো?
হ্যাঁ, চলুন যাই।
আমার একটু ভয় ভয় লাগতে থাকে। বললাম, লাঠিসোটা কিছু একটা নিয়ে গেলে হয় না?
সফদর আলী কথাটা হেসে উড়িয়ে দিয়েও কী মনে করে একটা লোহার রড তুলে নিলেন। আমরা দু’জন পা টিপেটিপে পাশের ঘরে এসে ঢুকলাম। ঘরে কিছু নেই, আবছা অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না। সফদর আলী হাততালি দিলেন, কিন্তু বাতি জ্বলল না। আবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু লাভ হল না। আমিও চেষ্টা করি, কিন্তু বাতি আর জ্বলল না। সফদর আলী চিন্তিত মুখে বললেন, আবার বাবুটা ফিউজ হয়েছে।
আমি অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপগুলো কোথায়?
ঐ তো। সফদর আলী হাত দিয়ে দেখিয়ে দেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমাদের ঘিরে দেয়াল ঘেঁষে চারদিকে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু দেখেই আমার মনে হল সবগুলো বাজে মতলব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
কী জানি! সার্কিট কেটে গেছে হয়তো সফদর আলীর কথা শেষ হবার আগেই ডানপাশে একটা গাছগাড়িতে দুটো বাতি জ্বলে ওঠে। শুধু তাই নয়, বাতি দুটি পিটপিট করতে থাকে। দেখে মনে হয় এক জোড়া চোখ। আমি আঁৎকে উঠে বললাম, ওটা কি?
বাতি।
চোখের মতো লাগছে দেখি, পিটপিট করছে কেন?
না, চোখ নয়। পোকা-মাকড় আলো দেখলে এগিয়ে আসে। তাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম, গাছগাড়ি পোকা-মাকড় ধরতে হলে বাতি জ্বালিয়ে নেয়।
কিন্তু দেখুন আপনি, কেমন পিটপিট করছে, ঠিক চোখের মতো।
সফদর আলী দুর্বলভাবে হেসে বললেন, ঠাট্টা করে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম, দেখতে চোখের মতো দেখায় কিনা!
ঠিক এই সময় চোখ জোড়া ঘুরে আমাদের ওপর এসে পড়ে। আমি প্রায় চেচিয়ে উঠি, আমাদের উপর আলো ফেলছে কেন?
কী জানি! আমাদের পোকা ভাবছে নাকি?
আমি ভয়েভয়ে ভাঁটার মতো চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ দেখি সেটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমি ফিসফিস করে বললাম, সফদর সাহেব, চলুন পালাই।
ভয়ের কী আছে! একটা গাছই তো।
আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে কেন? আমার গলার স্বর কেঁপে ওঠে। খেয়ে তো ফেলতে পারবে না—সফদর আলী সাহস দেয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু গলার স্বরে বোঝা গেল তিনি নিজেও একটু ভয় পেয়েছেন। গাছটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। আমি খেয়াল করলাম, ওটার সামনে দিয়ে শুড়ের মতো কী একটা যেন বের হয়ে আছে। ফুট চারেক উচু। সেটা দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
শুড়ের মতো ওটা কি?
সফদর আলী ঢোক গিলে বললেন, ওটা ইলেকট্রিক শক দিয়ে পোকা মারার জন্যে। ওটাতেই হাই ভোল্টেজ।
ওটা বের করে এগিয়ে আসছে কেন?
মনে হয় আমাদের শক মারতে চায়।
সর্বনাশ! আমি আঁৎকে উঠে বললাম, চলুন পালাই!
চলুন। সফদর আলী হঠাৎ করে রাজি হয়ে গেলেন। আমরা দু’জন ঘুরে দাঁড়াই, দরজার দিকে এগুতেই হঠাৎ আমাদের চক্ষু স্থির হয়ে গেল, দুটি গাছ গুটি গুটি দরজার সামনে এগিয়ে এসেছে। আমরা ঘুরতেই তাদের ভাঁটার মতো দুটি চোখ জ্বলে উঠল। শুধু তাই নয়, ইলেকট্রিক শক দেয়ার শুড়টা দোলাতে দোলাতে আস্তে আস্তে এগুতে থাকে। আমি সফদর আলীর দিকে তাকালাম, এখন?
সফদর আলী মাথা চুলকে বললেন, বাম দিকে চেষ্টা করি, ঐ জানালার ওপরে উঠে–
চেষ্টা করার আগেই বাম দিকে, ডান দিকে, সামনে, পিছনে গাছগুলোর চোখ জ্বলে উঠতে থাকে। আমরা চারদিক দিয়ে ঘেরাও হয়ে গেলাম। এবারে গাছগুলো শুড় দুলিয়ে আস্তে-আস্তে এগুতে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ একটা দুটি শুড় থেকে বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে আসে।
ভয়ে আমার হৃৎস্পন্দন থেমে যাবার মতো অবস্থা। সফদর আলীর হাত চেপে ধরে বললাম, এখন?
সফদর আলী ভাঙা গলায় বললেন, ঝামেলা হয়ে গেল।