বলেছিলেন। কী ভাবে পোকাগুলোকে মারবে?
হাই ভোল্টেজ দিয়ে।
ও।
একটা লম্বা তার বেরিয়ে আসবে। তারের মাথায় থাকবে বিশ হাজার ভোেট। পোকা-মাকড়ের গায়ে লাগতেই প্রচণ্ড স্পার্ক, আর সেটা এসে পড়বে ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপের উপর, ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপ তখন কপ কপ করে সেটা খেয়ে নেবে।
দৃশ্যটা কল্পনা করেই আমার গায়ে কেমন জানি কাঁটা দিয়ে ওঠে। আলোচনার বিষয়বস্তু পাল্টানোর জন্যে বললাম, আপনার গাছগাড়ি কই? বলছিলেন যে গান শুনতে যায়, দেখাবেন একটু?
সফদর আলী অপ্রতিভের মতো বললেন, ঐ যা! হাই ভোল্টেজের ব্যবস্থা করার জন্যে সবগুলো খুলে ফেলেছি।
তাকিয়ে দেখি বেশ কয়টা গাছগাড়ি, সবগুলোই খোলা। সফদর আলী ভেতরে এখন যন্ত্রপাতি ভরছেন। স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে কী একটা জিনিস চেপে ধরে বললেন, আর একটু অপেক্ষা করুন, দেখবেন এগুলো পোকা-মাকড় রে বেড়াবে, গান শোনা থেকে সেটা বেশি মজার।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কতক্ষণ লাগবে?
এই তো ঘন্টাখানেকের মধ্যে একটা দাঁড়িয়ে যাবে।
কিন্তু ঘন্টাখানেকের মধ্যে জিনিসটা দাঁড় হল না। প্রচণ্ড হাই ভোল্টেজের স্পার্ক হতেই সেটা ইলেকট্রনিক সার্কিটের অনেক জায়গায় কী ভাবে জানি ঝামেলা করে ফেলছিল। মাইক্রোপ্রসেসরে ভুল পালস এসে সেটাকে নাকি বিভ্রান্ত করে দেয়, কাজেই পুরো সার্কিটটাকে নাকি খুব ভালো করে “শিল্ডিং করতে হবে। সফদর আলী সবকিছু খুলে আবার একেবারে গোড়া থেকে শুরু করলেন, ধৈর্য আছে বটে! আমি আর বসে থেকে কী করব, বাসায় ফিরে এলাম।
বেশ কয়দিন কেটে গেছে, আমি মাঝে মাঝেই খোঁজ নিই। কিন্তু কিছুতেই সফদর আলীর কাজ শেষ হয় না। যখন শুনি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন হঠাৎ করে একটা হাই ভোল্টেজের স্পার্ক আৱেকটা ট্রানজিস্টর না হয় আরেকটা আই. সি.-কে পুড়িয়ে দেয়। সফদর আলী তখন আবার একেবারে গোড়া থেকে শুরু করেন। দেখে-দেখে আমি প্রায় হাল ছেড়ে দিলাম, তখন আবার আমাকে কয়দিনের ছুটি নিতে হল। মা অনেক দিন থেকে বলছেন নেত্রকোনা যাবেন, তাকে নিয়ে যাবার লোক নেই। কাজেই প্রায় সপ্তাহখানেক নেত্রকোনায় থেকে যখন ফিরে এসেছি, তখন দেখি আমার নামে বেশ কয়েকটা টেলিগ্রাম, বাসার সবাই সেগুলো খুলে পড়েছে। টেলিগ্রাম হলেই জরুরি খবর ভেবে সেগুলো খুলে ফেলা হয়। টেলিগ্রামগুলো এরকম—
প্রথমটি; কাজ শেষ।
দ্বিতীয়টি : কাজ শেষ। আসুন এবং দেখুন। হিন্দি গান।
তৃতীয়টি : কাজ শেষ। আসুন এবং দেখুন। বীভৎস।
চতুর্থটি : জরুরি। রাজশাহী। পিচার প্লান্ট।
বাসার কেউ টেলিগ্রামগুলো পড়ে কিছু বোঝে নি এবং সেটা নিয়ে বেশি মাথাও ঘামায় নি, সবাই জেনে গেছে আমার একজন আধপাগল বন্ধু আছে, সে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে শুধু টেলিগ্রাম পাঠায়। আমার অবশ্যি টেলিগ্রামগুলো বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না, ভিনাস ফ্লাইট্র্যাপ বসিয়ে গাড়ি বানানো শেষ হয়েছে, সফদর আলী আমাকে গিয়ে দেখতে বলেছেন। গাছগুলো নিশ্চয়ই হিন্দি গান শুনতে পছন্দ করে এবং যেভাবে পোকা ধরে খাচ্ছে, ব্যাপারটা হয়তো বীভৎস। শেষ টেলিগ্রাম পড়ে মনে হল তিনি জরুরি কাজে রাজশাহী যাচ্ছেন। পিচার প্লান্ট কথাটার অর্থ ঠিক ধরতে পারলাম না। ডিকশনারি খুলে দেখলাম এটি আরেকটি পোকা-খেকো গাছ। গাছের পাতার নিচে একটা ছোট কলসির মতো থাকে, সেখানে এক ধরনের রস থাকে। পোকা-মাকড় তার লোভে কলসির ভেতরে ঢুকে পড়ে, তখন গাছ কলসির মুখ বন্ধ করে ফেলে। মুখ আবার যখন খোলে তখন ভেতরের পোকা হজম হয়ে গেছে। টেলিগ্রামের পুরো অর্থ এবারে বুঝতে পারলাম। রাজশাহীতে নিশ্চয়ই তিনি এধরনের কোনো গাছের সন্ধান পেয়ে জরুরি নোটিশে চলে গেছেন। সফদর আলী এখানে নেই জেনেও একদিন তার বাসা থেকে ঘুরে এলাম। ঘর তালাবন্ধ। কিন্তু ভেতরে মনে হল গুটখট শব্দ হচ্ছে। জংবাহাদুরের কুই কুই আওয়াজও মনে হল শুনলাম কয়েক বার। এদিক-সেদিক দেখে উৎসাহজনক বা সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
আরো কয়দিন পরের কথা। আমি অফিসে কাজ করতে করতে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি। ছুটির সময় প্রায় হয়ে এসেছে। এমন সময় শুনি বাইরে সফদর আলীর গলার স্বর। সেক্রেটারির কাছে আমার খোজ করছেন। আমি অবাক হয়ে বেরিয়ে এলাম, সফদর আলীকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে। আমাকে দেখে যেন আরো উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার সফদর সাহেব? কবে এলেন?
এই তো, একটু আগে। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে।
কেন? কী হয়েছে?
জানি না। স্টেশন থেকে বাসায় পৌঁছে যেই দরজা খুলেছি, চিৎকার করতে-করতে জংবাহাদুর বেরিয়ে এসে বাসার কার্নিশে উঠে গিয়ে বসে পড়ল। আমি যতই ডাকি, কিছুতেই নিচে নামতে চায় না। ভেতরে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে।
কী দেখে?
বুঝতে পারলাম না, ভয় পাবার মতো কিছু তো নেই বাসায়।
আমি একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপগুলো?
সেগুলোতে ভয় পাবার কী আছে? যেভাবে পোকা মারে, দেখে একটু ঘেন্না ঘেন্না লাগে। কিন্তু ভয় পাবার তো কিছুই নেই।
এখন কী করতে চান?
বাসায় জিনিসগুলো রেখে কোনোমতে চলে এসেছি। আপনাকে নিয়ে এখন যাব। একা একা যেতে সাহস পাচ্ছি না।
অফিস প্রায় ছুটি হয়েই গেছে, আমি কাগজপত্র গুছিয়ে সফদর আলীর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। সফদর আলী জানালেন, রাজশাহী গিয়ে কোনো লাভ হয় নি। যে বলেছিল তাঁকে পিচার প্লান্ট জোগাড় করে দেবে, সে জোগাড় করে দিতে পারল না। সেখানে শুনলেন, বগুড়াতে এক নার্সারিতে নাকি আছে। সেখানে গিয়েও পেলেন না। ঘোরাঘুরিই হয়েছে, কোনো কাজ হয় নি।