আমি রাগ লুকানোর কোনো চেষ্টা না করে বললাম, আর ঐ বজ্জাত বানরটা কেমন পেট চেপে ধরে হাসা শুরু করেছিল দেখেছিলেন?
সফদর আলী মাথা নেড়ে বললেন, ওটা আমার দোষ। বানরকে হাসতে শেখানোর কোনো দরকার ছিল না, এখন যখন খুশি হাসতে থাকে। ভদ্রতাজ্ঞানটুকু নেই। আপনি যে আছাড় খেয়ে পড়লেন, দেখে যত হাসিই পাক, জংবাহাদুরের মোটেই হাসা উচিত হয় নি। আমি কি হেসেছিলাম?
আমি স্বীকার করলাম তিনি হাসেন নি। যাই হোক, আমার কৌতূহল আর বাঁধ। মানছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, গাছগাড়ির কী হল, বলুন।
সফদর আলী সবকিছু খুলে বললেন। সার্কিটের কানেকশান একটু পরিবর্তন করে। দেয়ার পর গাছগাড়ি ঠিক ঠিক কাজ শুরু করেছে। ভোরে রোদ উঠতেই গাছটা রোদে হাজির হয়, আবার রোদটা বেড়ে গেলে রোদ থেকে ছায়ায় সরে যায়। ঘরের এক কোনায় একটু পানি ছেড়ে রেখেছিলেন। গাছ কী ভাবে কী ভাবে সেটা বুঝে নিয়ে দিনে এক বার পানির নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। কোথায় নাকি পড়েছিলেন যে গাছের সাথে কথা বললে নাকি গাছ ভালো থাকে। সফদর আলী কী নিয়ে কথা বলবেন ভেবে পান নি বলে একটা রেকর্ড প্লেয়ারে কিছু গানের ব্যবস্থা করেছেন। গাছটা আজকাল নাকি রীতিমতো গান শুনছে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের দিকে নাকি গাছটার বিশেষ আকর্ষণ। একটা রেকর্ড চাপিয়ে দিলেই গাছ নাকি পড়িমরি করে ছুটে আসে। সফদর আলী আরো গোটা দশেক গাছগাড়ি তৈরি করে ভিন্ন ভিন্ন গাছ বসিয়ে, দেখতে চান কোনটা কী রকম কাজ করে। তাঁর বিশেষ ইচ্ছা কোন গাছ কী গান শুনতে পছন্দ করে সেটা বের করা। তিনি নাকি গাছের সংগীতচর্চা” নাম দিয়ে একটা বই লিখবেন বলে ঠিক করেছেন। আমার পরিচিত কোনো প্রকাশক আছে কি না জানতে চাইলেন। তিনি পোকা খেতে পছন্দ করে এরকম একটা গাছ খুজছেন, তাহলে সেই গাছগাড়িতে পোকা মারার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। গাছটা তাহলে পোক মেরে খেতে পারবে। ঘরে তেলাপোকার উপদ্রব থাকলে তো কথাই নেই, একদিনে ঘর পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সফদর আলীর গাছগাড়ি দেখার কৌতূহল আর আটকে রাখা যাচ্ছিল না। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। তাই ঠিক করা হল পরদিন বিকেলে আলো থাকতে থাকতে তাঁর বাসায় যাব। গাছপালা ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াচ্ছে, আলো ও পানি খুঁজে নিচ্ছে, গান শুনছে—এর থেকে বিচিত্র জিনিস আর কী হতে পারে!
পরদিন বিকালে সফদর আলীর বাসায় গিয়ে দেখি বাসা বাইরে থেকে তালাবন্ধ, ঘরের দরজায় একটা খাম, খামের উপরে আমার নাম লেখা। ভিতরে একটা চিঠি, চিঠিটা এরকম :
সুসংবাদ। ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপ। জরুরি। চট্টগ্রাম। উদ্ভিদবিদ্যা প্রফেসর। দুঃখিত।
টেলিগ্রাম করে করে তাঁর স্বাভাবিক চিঠি লেখার ক্ষমতা চলে গেছে। তবু বুঝতে অসুবিধে হল না। চট্টগ্রামের কোনো এক উদ্ভিদবিদ্যার প্রফেসর ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপ নামের পোকা-খাওয়া-গাছ জোগাড় করে দেবেন বলে তাঁকে তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে হয়েছে। আমার সাথে দেখা হল না বলে দুঃখিত। আমি একটু নিরাশ হলাম, কিন্তু খুশিও হলাম, সেদিন যেভাবে ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপের জন্যে হা-হুতাশ করছিলেন যে আমার বেশ খারাপই লাগছিল।
তারপর বেশ কয়দিন সফদর আলীর খোঁজ নেই। তিনি ফিরে এসেছেন কি না জানি না। বাসায় গিয়ে খোঁজ নেব ভাবছিলাম। কিন্তু কাজের চাপে সময় পাচ্ছি না। তার মধ্যে হঠাৎ একদিন টেলিগ্রাম এসে হাজির :
ডজন। ভিনাস। হাই ভোল্টেজ।
প্রথম অংশটা বুঝতে পারলাম। তিনি এক ডজন ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপ গাছ পেয়েছেন, কিন্তু হাই ভোল্টজ কথাটি দিয়ে কী বোঝাতে চাইছেন ধরতে পারলাম না। যাই হোক, দেরি না করে সেদিনই আমি সফদর আলীর বাসায় গিয়ে হাজির। জংবাহাদুর দরজা খুলে আমাকে সফদর আলীর কাছে নিয়ে গেল। তিনি তাঁর ঘরে অসংখ্য যন্ত্রপাতির মাঝে উবু হয়ে বসে ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, ইকবাল সাহেব, দেখে যান কী পেয়েছি।
একটু এগিয়ে দেখি ছোট ছোট বারটা টবে ছোট ছোট বারটা গাছ। গাছের পাতাগুলো ভারি অদ্ভুত, চারদিকে কাঁটার মতো বেরিয়ে আছে। কোনো কোনো পাতা খোলা, কোনো কোনোটা বন্ধ হয়ে আছে। আমি বললাম, এই কি সেই ভিনাস ফ্লাই ট্যাপ?
হ্যাঁ, দেখুন মজা দেখাই।
সফদর আলী টেবিলে রাখা কাঁচা মাংসের খানিকটা কিমা থেকে একটু তুলে নিয়ে গাছের পাতার ওপর ছেড়ে দিলেন। আর কী আশ্চর্য, গাছের পাতাটা ভাঁজ হয়ে বন্ধ হয়ে মাংসটুকু ঢেকে ফেলল! সফদর আলী বললেন, যখন পাতাটা খুলবে, দেখবেন মাংসটুকু নেই।
কখন খুলবে?
সময় লাগবে, মাংস হজম করা তো সহজ নয়।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, দুনিয়াতে কত কী যে দেখার আছে, একটা জীবনে তার কতটুকু মাত্র দেখা যায়?
সফদর আলী বললেন, আপনার কাজ না থাকলে সবগুলো গাছকে একটু করে কিমা খাওয়ান দেখি।
যদিও জানি ছোট এইটুকু গাছে ভয় পাবার কিছু নেই, তবু আমার একটু ভয় ভয় লাগতে থাকে। সাবধানে আমি একটু একটু করে কিমা গাছগুলোকে খাওয়াতে থাকি। পাতার ওপরে রাখতেই পাতাটা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। সফদর আলী খানিকক্ষণ আমাকে লক্ষ করে আবার যন্ত্রপাতির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে যে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন সেখানে লিখেছেন, হাই ভোল্টেজ, সেটার মানে কি?
সফদর আলী একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন, বলেন, বুঝতে পারেন নি?
নাহ্! আমার একটু লজ্জাই লাগে স্বীকার করতে।
আপনাকে বলেছি না ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপ, যে গাছগাড়িতে থাকবে সেখানে পোকা। মারার ব্যবস্থা থাকবে।