সফদর আলী আবার জিলিপি অর্ডার দিলেন। আজকেও টর্চ লাইটের মতো দেখতে সেই ঠাণ্ডা করার যন্ত্রটা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে খুব তাড়াহুড়া নেই। আমি তাই আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম, প্রায়ই আসেন বুঝি এখানে?
না, শুধু বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবার ছুটি কিনা!
কোনো অফিস বৃহস্পতিবার ছুটি হয় আমি জানতাম না, তাই একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী অফিস এটা যে বৃহস্পতিবারে আপনার ছুটি?
না না, আমার ছুটি নয়। বৃহস্পতিবার আমি ছুটি দিই।
কাদের ছুটি দেন?
এই, আমার একধরনের ছাত্রদের বলতে পারেন। সফদর আলী একটু আমতা আমতা করে থেমে গেলেন, ঠিক বলতে চাইছেন না, তাই আমি আর তাঁকে ঘাটালাম না।
সফর আলী খুব মিশুক নন, তবে কথাবার্তা বলেন। অনেকক্ষণ ধরে তার সাথে কথা হল। অনেক কিছু জানেন আর মাথায় অনেক ধরনের পরিকল্পনা, তাই তাঁর কথা শুনতেই ভারি মজা! ব্যাঙের ছাতার চাষ করে কী ভাবে খাদ্য সমস্যা মেটানো যায় বা কেঁচো পুষে কী ভাবে ঘরের আবর্জনা দূর করা যায়, সে থেকে শুরু করে সংখ্যা কেন দশভিত্তিক না হয়ে যোলভিত্তিক হওয়া দরকার—এধরনের ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ। সংখ্যা যোলভিত্তিক হলে কম্পিউটার দিয়ে কাজ করা নাকি খুব সহজ হবে, আজকাল সব মাইক্রোপ্রসেসর নাকি বোল কিংবা বত্রিশ বিটের হয়, সেটার মানে কী, আমি জানি না। সফদর আলী বলেছেন, আমাকে আরেক দিন বুঝিয়ে দেবেন। তিনি নিজে সবসময়েই যোলভিত্তিক সংখ্যায় হিসেব করেন, তাই তিনি গোনেন খুব অদ্ভুতভাবে। সাত, আট, নয়ের পর দশ না বলে বলেন কুরা। তারপর কিলি, চিংগা, পিরু, মিকা, ফিকার পরে নাকি আসে দশ! আর সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, তিনি যখন দশ বলেন তার অর্থ নাকি মোল! তিনি যখন বলেন এক শ’, তার অর্থ নাকি দুই শ’ ছাপ্পান্ন। ব্যাপারটি যে ফাজলামি নয় সেটা আমি জেনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের প্রফেসরের সাথে কথা বলে, সত্যি নাকি এ ধরনের সংখ্যা হওয়া সম্ভব।
পরের বৃহস্পতিবার আবার সফদর আলীর সাথে দেখা। তাঁকে একটু চিন্তিত দেখা গেল। গিনিপিগের লোমে তেল-হলুদ লেগে গেলে সেটা কী ভাবে পরিষ্কার করা যায় বা লোম পুড়ে গেলে পোড়া গন্ধটা দূর করা যায় কী ভাবে জানি কি-না জিজ্ঞেস করলেন। খুব সঙ্গত কারণেই আমি সেটা জানতাম না, গিনিপিগের ললামে তেল-হলুদ লাগতে পারে কী ভাবে কিংবা পুড়ে যেতে পারে কী ভাবে, সেটা কিছুতেই আমার মাথায় এল না। তিনি কি শেষ পর্যন্ত গিনিপিগ রান্না করে খাওয়া শুরু করেছেন। নাকি?
আজ কথাবার্তা খুব বেশি জমল না। কী যেন চিন্তা করে একটা কাগজে অনেকগুলো দাগ টেনে একটা দাগ আরেকটার সাথে জুড়ে দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখতে লাগলেন। আমি তাঁকে আর বিরক্ত করলাম না, আমার নিজেরও কাজ ছিল, তাই উঠে পড়ার উদ্যোগ করতেই সফদর আলী জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বিরিয়ানি রান্না করতে পারেন?
আমি? বিরিয়ানি? আমি মাথা নেড়ে জানালাম, রাঁধতে পারি না, শুধু খেতে পারি।
সফদর আলীর মুখটা একটু বিমর্ষ হয়ে গেল দেখে বললাম, আমার বোন থাকে শান্তিনগরে, সে খুব ভালো কাচ্চি বিরিয়ানি রাঁধতে পারে।
সফদর আলী খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বোনকে বলবেন একটা কাগজে লিখে দিতে? বুঝলেন কিনা, করব যখন ভালো করেই করি!
কী করবেন?
সফদর আলী আমতা আমতা করে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন, তাই আমি আর কিছু বললাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কবে দরকার আপনার বিরিয়ানির রেসিপি?
কাল দিতে পারবেন?
কোথায় দেব?
এইখানে।
আমার তাঁর বাসাটা দেখার ইচ্ছে, তাই বললাম, আপনার বাসাতে নিয়ে আসতে পারি, আমার কোনো অসুবিধে নেই।
সফদর আলী একটু ইতস্তত করে রাজি হলেন। একটা কাগজে ঠিকানাটা লিখে দিলেন, শ্যামলীর কাছে কোথায় জানি থাকেন।
পরদিন আমি ঠিকানা খুঁজে সফদর আলীর বাসা বের করলাম। একটু নির্জন এলাকায় বেশ বড় একটা একতলা বাসা। দরজায় বেল টিপতেই ঘেউঘেউ করে একটা কুকুর ভয়ানক রাগী গলায় চিৎকার করতে থাকে। কুকুরকে আমার খুব ভয় করে, আমি তাড়াতাড়ি দুই পা পিছিয়ে আসি। সফদর আলী দরজা একটু ফাঁক করে নিজের মাথাটা বের করে জিজ্ঞেস করলেন, এনেছেন?
আমি ভেবেছিলাম আমাকে হয়তো ভিতরে বসতে বলবেন, কিন্তু তার সেরকম ইচ্ছে আছে বলে মনে হল না। বদরাগী কুকুরটার ডাক শুনে আমার নিজের ইচ্ছেও কমে এসেছে, তাঁর হাতে কাগজটা দিয়ে চলে এলাম। আসার আগে দরজার ফাঁক দিয়ে একটু উঁকি মারার চেষ্টা করে মনে হল মেঝেতে ইঁদুরের মতো অনেকগুলো কী যেন ঘোরাঘুরি করছে। গিনিপিগের কথা বলছিলেন, তাই হবে হয়তো।
পরের বৃহস্পতিবার সফদর আলীকে খুব খুশি খুশি দেখা গেল। নিজে থেকে আলাপ শুরু করলেন, বললেন, বুঝলেন ইকবাল সাহেব, আমার কাজ প্রায় শেষ। এখন লবণ একটু কম হয়, কিন্তু এমনিতে ফার্স্ট ক্লাস জিনিস!
কিসে লবণ কম হয়?
কেন, বিরিয়ানিতে! মনে নেই আপনি রেসিপি এনে দিলেন?
ও। আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি নিজেই রাঁধছেন বুঝি?
মাথা খারাপ আপনার, আমি রাঁধব? রান্না করা আমার দু’চোখের বিষ!
তাহলে কি ভালো বাবুচি পেয়েছেন নাকি?
সফদর আলী হা হা করে হাসলেন, বাবুর্চি বলতেও পারেন ইচ্ছা করলে। গিনিপিগ। বাবুটি!
মানে?
আমার রান্না করে দেয় গিনিপিগেরা!
আমি গরম চা খাচ্ছিলাম, বিষম খেয়ে তালু পুড়ে গেল। মুখ হাঁ করে খানিকক্ষণ বাতাস টেনে জিজ্ঞেস করলাম, কী বললেন! গিনিপিগেরা?