ব্যাপারটা সহজ নয়, তবু চেষ্টা করলাম।
এবারে কলাটা নেয়ার জন্যে এগিয়ে আসুন।
আমি কলাটি ধরার জন্যে একটু এগুতেই শরীরের ওপরের অংশ সামনে ঝুঁকে এল, ম্যাজিকের মতো নিচের অংশ গেল পিছিয়ে। আমি তক্তার ওপর তাল সামলানোের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকি, কিন্তু কিছু বোঝার আগে আমাকে নিয়ে তক্তা মারবেলের উপর প্রচণ্ড বেগে পিছনে গড়িয়ে যায়। আমি হাতের কাছে যা আসে তাই ধরার চেষ্টা করতে থাকি। একটা ছোট আলমারি ছিল, তাই ধরে ঝুলে পড়লাম। কিন্তু লাভ হল না, আলমারিসহ প্রচণ্ড জোরে মেঝেতে আছড়ে পড়ি। মনে হল শরীরের সব হাড়গোড় ভেঙে গেছে, নাড়িভুঁড়ি ফেসে গেছে, ঘিলু মাথা ফেটে বের হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে গেছে। চোখের সামনে নানা রঙের আলো খেলা করতে থাকে। হলুদ রঙের প্রাধান্যই বেশি। প্রথমে ভাবলাম, আমি বোধহয় মরেই গেছি, সাবধানে চোখ খুলে দেখি মরি নি, কারণ জংবাহাদুর ঘুলঘুলিতে ঝুলে থেকেই পেট চেপে ধরে প্রচণ্ড হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মনে হল বোধহয় মরে গেলেই ভালো ছিল। তাহলে অন্তত এই দৃশ্যটি দেখতে হত না, চোখ বন্ধ করে ফেললাম উপায় না দেখে। আবার যখন চোখ খুললাম, দেখি মুখের উপর সফদর আলী ঝুকে আছেন। শুনলাম তিনি বলছেন, দেখলেন? আপনি সামনে আসার চেষ্টা করছিলেন আর কেন পিছিয়ে গেলেন! গাছের বেলাতেও একই ব্যাপার, যাকে বলে ভরবেগের সাম্যতা! গাছ চেষ্টা করে সামনে আসতে, কিন্তু যায় পিছিয়ে।
আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেলি, এবারে আর কোনো সন্দেহ থাকে না যে মরে গেলেই ভালো ছিল।
সে রাতে যখন বাসায় ফিরেছি, তখন আমার কপালে এবং হাতে বান্ডেজ। একটা চোখ বুজে আছে, সেটা দিয়ে আপাতত কিছু দেখা যাচ্ছে না। হাঁটতে হচ্ছে খুঁড়িয়ে। কারণ কোমর, হাঁটু এবং গোড়ালিতে প্রচণ্ড ব্যথা।
আমাকে দেখে মা আঁৎকে উঠলেন, সে কী! এ কী চেহারা তোর, অ্যাকসিডেন্ট কি?
না, অ্যাকসিডেন্ট না।
তাহলে? মারামারি করেছিস নাকি?
মারামারি করব কেন?
নিশ্চয়ই করেছিস, তা ছাড়া এরকম চেহারা হবে কেন?
বললাম তো মারামারি করি নি।
আবার মিথ্যা কথা বলছিস! এই বয়সে রাস্তায় মারপিট করে এসে আবার আমার সাথে মিথ্যা কথা
বললাম তো মারপিট করি নি।
আমার কথা মা শুনলেন না। চোখে আঁচল দিয়ে বললেন, আমি কোথায় যাই গো। এরকম একটা খুনে ছেলেকে পেটে ধরেছি! তোর নানা কত বড় খান্দানী বংশের লোক, আর তার নাতি রাস্তায় গুণ্ডাদের সাথে মারপিট করে আসে—
সফদর আলীর বাসায় সেই রাম আছাড় খাবার পর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এখন থেকে কোনো অবস্থাতেই আর তাঁর বাসায় যাচ্ছি না। দেখা করতে হলে চায়ের দোকানে দেখা-সাক্ষাৎ কথাবার্তা হবে। বিজ্ঞানীরা বড় ভয়ংকর জিনিস, তাদের সাথে আর হাতেকলমে কোনো কাজকর্ম নেই।
সপ্তাহখানেক কেটে গেল, চোখের ফোলা কমেছে। হাত দিয়ে জিনিসপত্র ধরা শুরু করেছি। কোমরের ব্যথাটা এখনো আছে, ডাক্তার বলেছে সারতে সময় নেবে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে হয়। অফিসে সেকশান অফিসার বললেন, শেয়ালের মাংস খেলে নানি ব্যথা-বেদনা ভালো হয়ে যায়। আর কয়দিন অপেক্ষা করে হয়তো শেয়াল ধরতে বের হতে হবে। অফিস ফেরত কয়দিন কাওরান বাজারে সেই চায়ের দোকানে ঢু মেরে গেছি, সফদর আলীর দেখা পাই নি। তাঁর গাছগাড়ির কী হল জানার কৌতূহল হচ্ছিল কিন্তু বাসায় যাওয়ার ভরসা পাচ্ছি না।
দু’সপ্তাহের মাথায় সফদর আলীর সাথে দেখা। আমি চা খেয়ে বের হচ্ছিলাম, দেখি তিনি হেলতে-দুলতে ঢুকছেন। আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে উঠলেন, এই যে আপনাকে পাওয়া গেছে, কতদিন থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। বলুন দেখি, কোন গাছ পোকা খায়?
পোকা খায়? গাছ?
হ্যাঁ, অনেকরকম গাছ পোকা ধরে খায়, জানেন না?
আমার মনে পড়ল কোথায় জানি পড়েছিলাম যে, কিছু কিছু গাছ নাকি পোকা। ধরে খায়। একটা গল্পও পড়েছিলাম যে মাদাগাস্কার দ্বীপে একটা গাছ নাকি মানুষ ধরে খেয়ে ফেলত। আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, শুনেছি কিছু গাছ নাকি পোকা খায়, কিন্তু সেরকম গাছ তো চিনি না।
তামাক গাছ নাকি পোকা খায়?
তাই নাকি, জানতাম না তো!
সফদর আলী চিন্তিত মুখে বললেন, একটা পোকা-খাওয়া-গাছ খুঁজে বেড়াচ্ছি। সবচেয়ে ভালো হয় যদি একটা “ভিনাস ফ্লাই ট্রাপ” পেয়ে যাই। ওটা একেবারে মাছিটাছি ধরে খেয়ে ফেলে।
কী করবেন ওরকম গাছ দিয়ে?
এখন গাছ গাড়ি চড়ে গান শুনতে যায়, রোদ পোহাতে যায়, পানি খেতে যায়, যদি “ভিনাস ফ্লাই ট্র্যাপ” পাই
কী বললেন? আমি চমকে উঠে বললাম, গাছগাড়ি চড়ে কী করে?
কেন? গান শোনে, রোদ পোহাতে যায়, পানি খেতে যায়।
গান শোনে?
হ্যাঁ। এত অবাক হচ্ছেন কেন? আপনি দেখলেন না?
কোথায় দেখলাম?
হঠাৎ সফদর আলীর সবকিছু মনে পড়ে যায়। মাথা নেড়ে বললেন, সেদিন পড়ে গিয়ে ব্যথা পাওয়ার পর তো আপনি আর আসেন নি। বেশি ব্যথা পেয়েছিলেন নাকি?
সফদর আলীর উপর রাগ করে থাকাও মুশকিল। চেপে থাকার চেষ্টা করলাম, তবু গলার স্বরে একটু রাগ প্রকাশ হয়ে গেল, না ব্যথা পাব কেন? বয়স্ক এক জন মানুষ যদি ওভাবে দড়াম করে পাকা মেঝেতে আছড়ে পড়ে, ব্যথা পাবে কেন?
সফদর আলী অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, আমি ঠিক বুঝতে পারি নি। কিন্তু পরে হিসাব করে দেখেছিলাম ওরকম হাবড়ে পড়ে সারা শরীরে ব্যথাটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে বেঁচে গিয়েছিলেন। পুরো চোটটা যদি এক জায়গায় লাগত তাহলে হাড় ভেঙে যেতে পারত।