উঁহুঁ। সফদর আলী মাথা নাড়েন, আসলে গেইন ঠিক নেই। ফিডব্যাক লুপটা ঠিক করতে হবে। জংবাহাদুর, একটা ছোট ড়ু-ড্রাইভার দাও।
জংবাহাদুর টেলিভিশনে একটা প্রচণ্ড মারামারির দৃশ্যে তন্ময় হয়ে ছিল, নেহায়েত অনিচ্ছায় উঠে এসে একটা স্ক্রু-ড্রাইভার এগিয়ে দেয়। সফদর আলী বললেন, লুপটা ঠিক করতে খানিকক্ষণ সময় লাগবে, আমি তাই জংবাহাদুরের পাশে বসে টেলিভিশন দেখতে থাকি।
রাত দশটার দিকে সফদর আলী ঘোষণা করেন, তাঁর গাছগাড়ি শেষ হয়েছে। জিনিসটা পরীক্ষা করতে গিয়ে আমরা দুজনেই খেয়াল করলাম এখন রাত। রোদ দিয়ে পরীক্ষা করার কোনো বুদ্ধি নেই। টেবিল ল্যাম্পের আলো দিয়ে পরীক্ষা করে কোনো লাভ হল না। গাছটা কাঁপতে থাকে, কিন্তু আলোর দিকে এগিয়ে না এসে মাঝেমাঝে বরং একটু পিছিয়েই যাচ্ছিল। ঠিক করা হল, পরদিন রোদ উঠলে পরীক্ষা করা হবে। আমি ভোরেই চলে আসব, কাল এমনিতেই আমার অফিস নেই।
পরদিন ভোরে নাস্তা করেই আমি সফদর আলীর বাসায় হাজির হই। বেশ রোদ উঠেছে। গাছগাড়ি পরীক্ষা করায় অসুবিধে হবার কথা নয়। সফদর আলীকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলাম, মুখ গম্ভীর এবং ভুরু কুঁচকে নিজের গোঁফ টানছেন! বোঝাই যাচ্ছে জিনিসটা ঠিক কাজ করে নি। ঘরের এক কোনায় গাছটা গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, অন্যদিকে জানালা খোলা, রোদ এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। আমি ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী ইল সফদর সাহেব?
আপনি নিজেই দেখুন, বলে সফদর আলী উঠে দাঁড়ান। জানালাটা বন্ধ করে প্রথমে ঘরটা অন্ধকার করে দিলেন। তারপর গাছগাড়িটাকে ঠেলে এনে ঘরের মাঝখানে রাখলেন। এবারে জানালাটা খুলে দিতেই ঘরে রোদ এসে পড়ল। সাথে সাথে গাড়িটা ঘরঘর শব্দ করে পিছিয়ে যেতে থাকে। সফদর আলী জানালাটা বন্ধ করে দিলেন। সাথে সাথে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। আবার জানালাটা খুলে দিলেন, গাড়িটা আবার রোপণ থেকে সরে যেতে থাকে। আশ্চর্য ব্যাপার! আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, গাছ। গাড়ি চালাচ্ছে।
কিন্তু ভুল দিকে চালাচ্ছে, রোদের দিকে না গিয়ে রোদ থেকে সরে যাচ্ছে।
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, তাতে কী আছে? আপনার সেই লাল তারের ভোল্টেজটা পাল্টে দিলে হয়। যখন পজিটিভ হওয়ার কথা তখন নিগেটিভ, যখন নিগেটিভ হওয়ার কথা তখন পজিটিভ। তা হলেই যখন পিছন দিকে যাচ্ছে তখন
ছোট বাচ্চারা অর্থহীন কোনো কথা বললে বড়রা যেভাবে তার দিকে তাকায়, সফদর আলী ঠিক সেভাবে আমার দিকে তাকালেন, তারপর আস্তে আস্তে বললেন, বিজ্ঞান মানে কি?
আমি হঠাৎ এরকম গুরুত্তর প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে থেমে গেলাম। সফদর আলী আহত গলায় বললেন, কোনো একটা জিনিসকে অন্ধের মতো কাজ করানো তো বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞান হচ্ছে বোঝা ব্যাপারটা কী হচ্ছে, বুঝে তারপর কাজ করা। বোকার মতো ভোল্টজ পাল্টে দিলেই তো হয় না, তাহলে সেটা তো আর বিজ্ঞান থাকে না, সেটা তাহলে জাদু হয়ে যায়।
এরকম একটা অবৈজ্ঞানিক কথা বলার জন্যে লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল, আমি তার কথাগুলো হজম করে মাথা নিচু করে বসে রইলাম। সফদর আলী বিজ্ঞান এবং মানুষের প্রকৃতির ওপর ছোটখাট একটা বক্তৃতা দিয়ে আবার গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন। আমি খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বিকেলের দিকে আবার আসব বলে উঠে এলাম। আজ আবার বাজার করার কথা, দেরি হলে কিছু আর পাওয়া যাবে না।
বিকেলে সফদর আলীর বাসায় পৌঁছে দেখি বাসা একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। সারা ঘরে ভাঙা পেয়ালা, পিরিচ, বাসনকোসন, বইপত্র ছড়ানো, চারদিকে পানি থৈথৈ করছে। ঘরে ছড়ানো-ছিটানো অসংখ্য মারবেল, এক কোনায় একটা বড় তক্তা। আমাকে দেখে সফদর আলী হৈহৈ করে উঠলেন। বের করে ফেলেছি সমাধান!
কিসের সমাধান?
গাছগাড়ি উল্টোদিকে যাচ্ছিল কেন।
সত্যি? আমি সাবধানে ঘরের মাঝে এসে দাঁড়ালাম, কেন যাচ্ছিল উল্টোদিকে?
আপনাকে চাক্ষুষ দেখাই, বলে তিনি উপরের দিকে তাকিয়ে হুঁঙ্কার দেন, নিচে নেমে আস, জংবাহাদুর।
আমি উপরে তাকিয়ে হতবাক হয়ে যাই, জংবাহাদুর বাসার ঘুলঘুলি ধরে ঝুলে আছে।
নেমে আস বলছি।
জংবাহাদুর নেমে আসার কোনো লক্ষণ দেখাল না, বরং কুঁই কুঁই করে প্রতিবাদ করে কী একটা বলল।
নেমে আস, এছাড়া তোমার টেলিভিশন দেখা বন্ধ।
জংবাহাদুর তবু নেমে আসল না। দেখে বুঝতে পারি ব্যাপার গুরুতর। আমি ভয়েভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখাতে চাইছেন?
জংবাহাদুর নেমে না এলে দেখাই কেমন করে? সফদর আলী এদিকে সেদিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকান, তাঁর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, হাতে কিল মেরে বললেন, এই তো আপনি আছেন, আপনি দেখাতে পারবেন।
যে জিনিস জংবাহাদুর করতে চাইছে না সেটা আমি গলা বাড়িয়ে করতে যাব, এত বোকা আমি নই, কিন্তু কিছু বলার আগেই দেখি সফদর আলী ঘরে ছড়ানো-ছিটানো মারবেলগুলো একত্র করে তার ওপরে তক্তাটা বসিয়ে আমাকে টেনেহিচড়ে তার ওপর তুলে ফেলেছেন।
তক্তার নিচে মারবেলগুলো কাজ করছে বল বিয়ারিঙের মতো। সাবধানে আমাকে ধরে রেখে সফদর আলী বললেন, তক্তাটি এখন খুব সহজে গড়িয়ে যাবে, কাজেই আপনি সাবধানে নড়াচড়া করবেন।
আমি চিৎকার করে নেমে পড়তে যাব, তার আগেই সফদর আলী আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, সাবধান! একটু অসাবধান হলেই কিন্তু আছড়ে পড়বেন।
আমি নাক-মুখ খিচিয়ে কোনোমতে তক্তার উপরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মনে হয় পায়ের নিচে পৃথিবী টলটলায়মান। একটু অসতর্ক হলেই একেবারে পপাত ধরণীতল! সফদর আলী কোথা থেকে একটা কলা তুলে নিয়ে আমার নাকের সামনে ঝুলিয়ে ধরে বললেন, মনে করুন আপনি জংবাদুর।