আমি সফদর আলীকে থামিয়ে দিলাম, তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, গাছ গাড়িটাকে চালাবে: অন্ধকারে রেখে দিলে গাছ গাড়িটাকে চালিয়ে রোদে এসে দাঁড়াবে?
হ্যাঁ।
গাছের কি হাত-পা আছে যে গাড়িকে চালাবে?।
আমি কি তাই বলেছি? আমি বলেছি ফিডব্যাক। গাছের পাতায়, ডালে ছোট-ছোট “সেন্সিং প্রোব” থাকবে। পাতা যদি ডান দিকে বেঁকে যাওয়ার চেষ্টা করে, “সেন্সিং পোব” সেটা অনুভব করে গাড়িটাকে ডান দিকে চালিয়ে নেবে। কন্ট্রোলটা খুব সহজ নয়, অনেকগুলো জটিল সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নতুন একটা মাইক্রোপ্রসেসর বের হয়েছে, সেটা দিয়ে সহজেই কন্ট্রোল করা যাবে। এই দেখেন, আমি ডিজাইনটা করেছি–
সফদর আলী একটা বড় কাগজ টেনে নিলেন, সেখানে হিজিবিজি করে অনেক জটিল নকশা আঁকা, দেখে ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, এখন এই পুরো জিনিসটা আমাকে বুঝতে হবে? সফদর আলী বোঝাতে শুরু করে হঠাৎ কেমন জানি মিইয়ে গিয়ে বললেন, খামাখা সময় নষ্ট করলাম, এসব নিশ্চয়ই তৈরি হয়ে গেছে!
পুরনো ঢাকায় গেলে হয়তো এখনি দু’ ডজন কিনে ফেলা যাবে!
কী বলছেন আপনি? আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, গাছ রোদের দিকে যায় সেটা সবাই জানে। তাই বলে গাছ গাড়ি চালিয়ে নিজে নিজে রোদের দিকে যাচ্ছে সেটা কখনো শুনি নি।
আপনি সত্যি জানেন?
এক শ’ বার জানি। এরকম একটা আবিষ্কার হলে আমি জানতাম না? আমি এক ঘন্টা লাগিয়ে রোজ খবরের কাগজ পড়ি।
সফদর আলীর মুষড়ে পড়া ভাবটা কেটে যায় হঠাৎ। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বলেন, তাহলে এটা তৈরি করা যাক। কী বলেন?
এক শ’ বার! আমি হাতে কিল মেরে বললাম, গাড়ি চালিয়ে গাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছবি ও ন। আপনার!
সফদর আলী লাজুক মুখে বললেন, খবরের কাগজে ছবি ছাপিয়ে কী হবে। শিশু আপনি যখন বলছেন, তখন তৈরি করা যাক জিনিসটা। খুব সহজ আসলে, আপনাকে বলি কী ভাবে কাজ করবে এটা–
আমি ভয়েভয়ে দেখলাম সফদর আলী কাগজটা টেনে নিচ্ছিলেন আবার, এমন সময় পর্দা ঠেলে জংবাহাদুর এসে ঢুকল। হাতে একটা ট্রে, তার উপর তিন কাপ চা এবং একটি কলা। আমাদের দু’জনের হাতে দুই কাপ চা ধরিয়ে দিয়ে জংবাহাদুর ইজিচেয়ারে তার নিজের চা এবং কলাটি নিয়ে বসে।
সফদর আলী আড়চোখে দেখে বললেন, বেটা কেমন পাজি দেখেছেন? নিজের জন্যে কলা এনেছে, আমাদের জন্যে কিছু না।
আমি হাত নেড়ে বললাম, আহা-হা ছেড়ে দেন, বেচারা একটা বানর ছাড়া তো আর কিছু নয়, চা যে এনেছে এই বেশি।
ভয়ে ভয়ে আমি চায়ে চুমুক দিয়ে হতবাক হয়ে যাই। চমৎকার সুগন্ধী চা, দুধ চিনি মাপমতো, এতটুকু কম-বেশি নেই। বললাম, বাহ্, চমৎকার চা তৈরি করেছে তো!
সফদর আলী চাপা গলায় বললেন, ‘আস্তে বলুন, শুনে ফেললে দেমাকে মাটিতে পা ফেলবে না। তারপর গলা আরো নামিয়ে বললেন, এই একটা জিনিস ভালো করে, এছাড়া ভীষণ আলসে।
আমি আড়চোখে জংবাহাদুরকে লক্ষ করি। চোখ আধবোজা করে বসে আছে, এক হাতে ধূমায়িত চা, অন্য হাতে কলা। কলাটা চায়ে ভিজিয়ে-ভিজিয়ে খাচ্ছে, এই দৃশ্য আমি আর কোথায় পেতাম!
সফদর আলীর নতুন আবিষ্কারটি কেমন এগুচ্ছে দেখার জন্যে আজকাল অফিস ফেরত বাসায় যাবার আগে সফদর আলীর বাসা হয়ে যাই। জংবাহাদুরের জন্যে কলাটামূলাটা কিনে নিই বলে আজকাল আমাকে দেখলেই চা তৈরি করে আনে। ইদানীং দেখছি আমাকে চায়ের সাথে একটা কলা ধরিয়ে দিচ্ছে। তাকে খুশি করার জন্যে কলাটা চায়ে ভিজিয়ে খেতে হয়, সত্যি কথা বলতে কি, বেশ লাগে খেতে!
সফদর আলী পুরোদমে কাজ করছেন। কলকজা বোঝাই ছোট একটা গাড়ি তৈরি হয়েছে, উপরে টব রাখার জায়গা। গাড়ি থেকে লাল আর নীল রঙের দুটি তার বের হয়ে এসেছে। লাল তারটিতে পজিটিভ ভোল্টেজ দিলে গাড়িটা সামনে যায়, নিগেটিভ দিলে পিছনে। নীল তারটিতে পজিটিভ ভোল্টেজ দিলে ডান দিকে, নিগেটিভ দিলে বাম দিকে। আমার সামনেই সফদর আলী পরীক্ষা করে দেখেছেন, গাড়িটা ঠিক ঠিক কাজ করে। এখন একটা ছোট ইলেকট্রনিক্সের বাক্স তৈরি করছেন, গাছ সামনে, পিছনে, ডান বা বাম দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে একটা ছোট সেন্সিং প্রোব এই বাক্সটা দিয়ে কী ভাবে জানি ঠিক তারগুলোতে ঠিক ঠিক ভোজে হাজির করবে। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ সহজই মনে হল।
আরো কয়দিন কেটে গেল, সফদর আলী দিন-রাত কাজ করছেন। ইলেকট্রনিক্সের অংশটুকু জটিল, সবরকম “আই. সি.” নাকি এখানে পাওয়া যায় না। তাই দেরি হচ্ছে। “ডিজিটাল” অংশটুকু তৈরি হয়ে গেছে, ওটা নাকি সহজ। “এনালগ” অংশটুকু এখনো শেষ হয় নি। হাই ফ্রিকোয়েন্সির অসিলেশান নাকি ঝামেলা করছে। আমি এসবের মানে বুঝি না, তাই শুধু শুনে যাই।
যেদিন পুরোটা তৈরি হল, আমার উৎসাহ দেখবে কে! একটা মানি প্লান্ট গাছ দিয়েই শুরু করা হল। টবটা ছোট গাড়িটার ওপর তুলে দিয়ে ছোট ছোট সেন্সিং প্রোবগুলো বিভিন্ন পাতায় লাগিয়ে দেয়া হল। চুষনির মতো জিনিস, চাপ দিয়ে ভেতরে বাতাসটা বের করে দিলে বেশ আটকে থাকে। সফদর আলী গাড়িটার ভেতরে দুটো ব্যাটারি ভরে সুইচ অন করতেই গাড়িটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁপতে থাকে, তারপর হঠাৎ একটু সামনে গিয়ে থেমে যায়। খানিকক্ষণ থেমে হঠাৎ পিছিয়ে আসে, তারপর আবার সামনে, তারপর আবার পিছনে।
মিনিট পাঁচেক এরকম করল, সফদর আলী চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকেন। আমি ইতস্তত করে বললাম, গাছটা মনস্থির করতে পারছে না মনে হচ্ছে। একবার সামনে যাচ্ছে, একবার পিছনে।