আমাকে স্বীকার করতেই হল যে পানি আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে কার্বোহাইড্রেড তৈরি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। পানির সাথে চিনি আর লেবুর রস দিয়ে শরবত তৈরি করতে পারি, কিন্তু কার্বোহাইড্রেড? অসম্ভব।
পৃথিবীর কোনো বিনী এখনো পারে নি, সালোকসংশ্লেষণ দিয়ে গাছ শুধু যে কার্বোহাইড্রেড তৈরি করে গই নয়, গাছ কার্বন-ডাই-অক্সাইড ভেঙে অক্সিজেন তৈরি করে, সেই অক্সিজেন না থাকলে কবে আমি আর আপনি দম বন্ধ হয়ে শেষ হয়ে যেতাম। সালোকসংশ্লেষণ কী ভাবে হয় জানেন?
সফদর আলী এরপর ঝাড়া আধ ঘন্টা লেকচার দিয়ে গেলেন। বিজ্ঞানীদের এই হচ্ছে সমস্যা, নতুন কিছু শিখলে সেটা অন্যদের না শিখিয়ে ছাড়বেন না।
সপ্তাহখানেক পরে হঠাৎ সফদর আলীর একটা টেলিগ্রাম এসে হাজির, টেলিগ্রামে লেখা “মহা আবিষ্কার”। ব্যস, শুধু এই দুটো শব্দ। এর আগেও কিছু নেই, এর পরেও কিছু নেই। সফদর আলীর কাণ্ডকারখানা দেখে আজকাল একটু অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই এমন কিছু অবাক হলাম না। মহা আবিষ্কারটা কী হতে পারে ঠিক ধরতে পারছিলাম না। গাছ নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন, তাই সম্ভবত গাছসংক্রান্ত কিছু একটা হবে। কে জানে পানি আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশিয়ে কার্বোহাইড্রেড বানানো শুরু করেছেন কি না। ঠিক করলাম অফিস ফেরত আজ তাঁর বাসা হয়ে আসব। সফদর আলী যদি দাবি করেন মহা আবিষ্কার, আবিষ্কারটা সাংঘাতিক কিছু না হয়ে যায় না।
বাসা খুঁজে বের করে দরজায় শব্দ করতেই ভেতর থেকে একাধিক কুকুর প্রচণ্ড শব্দ করে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। আমি ভালো করেই জানি বাসায় কোনো কুকুর নেই। বাইরের লোকদের ভয় দেখানোর ব্যবস্থা, তবু ঠিক সাহস হয় না, কুকুরকে আমার ভারি ভয়।
দরজা খুলে গেল। ভাবলাম সফদর আলীর মাথা উঁকি দেবে। কিন্তু উঁকি দিল জংবাহাদুরের মাথা। আমাকে দেখে দরজাটা হাট করে খুলে মুখ খিচিয়ে একটা হাসি দেবার ভঙ্গি করল বুড়ো বানরটা। নেহায়েত জংবাহাদুরকে চিনি। এছাড়া মুখ খিচিয়ে ওরকম ভঙ্গি করাকে হাসি মনে করার কোনো কারণ নেই। আতিথেয়তায় জবাহাদুরের তুলনা নেই, আমাকে প্রায় হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। ভেতরে আবছা অন্ধকার। একটা জানালা খোলা। সেখানে একটা টবে একটা মানি প্লান্ট গাছ নিয়ে সফদর আলী কী একটা করছিলেন, আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে ওঠেন। সফদর আলীকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে। চোখ দুটি মনে হয় জ্বলজ্বল করছে। বললেন, ইকবাল। সাহেব, মহা আবিষ্কার করে ফেলেছি।
তাই নাকি? আমি উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করলাম, কী আবিষ্কার?
বলছি, তার আগে চা খাওয়া যাক। সফদর আলী জংবাহাদুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, জংবাহাদুর, চা বানাও।
জংবাহাদুর একটা ইজিচেয়ারে আরাম করে পা দুলিয়ে বসে ছিল। সফদর আলীর কথাটা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করল।
সফদর আলী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বেটা কীরকম পাজি দেখেছেন?
আহা বেচারা! হয়তো কাজকর্ম করে কাহিল হয়ে পড়েছে।
কিসের কাহিল, সবকিছুতে ফাঁকিবাজি। দাঁড়ান, দেখাচ্ছি মজা। সফদর আলী আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, ঠিক আছে জংবাহাদুর, চা যদি বানাতে না চাও বানিও না, তবে আজ রাতে টেলিভিশন বন্ধ।
বলমাত্র জংবাহাদুরের চোখ খুলে যায়। তড়াক করে লাফ দিয়ে ওঠে, তারপর মুখে কুঁই কুঁই শব্দ করতে করতে দ্রুত ছুটে যায় রান্নাঘরের দিকে।
আমি চোখ গোল-গোল করে তাকিয়ে ছিলাম, অবাক হয়ে বললাম, টেলিভিশন দেখা এত পছন্দ করে?
সবদিন নয়। আজ রাতে বাংলা সিনেমা আছে তো! চলেন, আপনাকে দেখাই আমার আবিষ্কার।
সফদর আলী আমাকে টেনে জানালার কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে টবে সেই মানি প্লন্ট গাছটা। গাছটাকে দেখিয়ে বললেন, এই দেখেন। আমি তাকিয়ে দেখলাম, সাধারণ একটা গাছ। আবিষ্কারটি কী বুঝতে না পেরে বললাম, কী দেখব?
আমার আবিষ্কার।
কোথায়?
দেখছেন না?
আমি আবার তাকিয়ে দেখি, একটা টবে একটা মানি প্লান্ট গাছ, অস্বাভাবিক কিছু নেই। আবিষ্কারটি কী হতে পারে, গাছটার কি চোখ-নাক-মুখ আছে? খুঁজে দেখলাম নেই, তাহলে কি টবটা কোনো রাসায়নিক জিনিস দিয়ে বোঝাই? না, তাও নয়, তাহলে কী হতে পারে? মাথা চুলকে বললাম, না সফদর সাহেব, ধরতে পারছি না।
ধরতে পারছেন না? সফদর আলী একটু অধৈর্য হয়ে বললেন, দেখছেন না মানিপ্লান্টটা কেমন জানালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?
তা তো দেখছি, ওদিকে রোদ, ওদিকেই তো যাবে।
সফদর আলীর মাথায় বাজ পড়লেও তিনি এত অবাক হতেন না। চোখ বড় বড় করে বললেন, আপনি জানেন এটা?
না জানার কী আছে। সবাই জানে। ঘরের ভেতরে গাছ থাকলে যেদিকে আলো, গাছ সেদিকে বাড়তে থাকে। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটাই কী আপনার আবিষ্কার?
সফদর আলী দুর্বলভাবে মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ।
আমার তাঁর জন্যে মায়া হল। বেচারা একা একা থাকে। কোনো কিছু খোঁজখবর রাখেন না। যেটা সবাই জানে সেটা তাঁকে একা একা আবিষ্কার করতে হয়। তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। বাধা দিয়ে বললেন, তাহলে নিশ্চয়ই সেন্সিং ফিডব্যাকও আবিষ্কার হয়ে গেছে। আমি আরো ভাবলাম—
কী বললেন? সেন্সিং কী জিনিস?
সেন্সিং ফিডব্যাক।
সেটা কী জিনিস?
সফদর আলী আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কোনদিকে আলো আছে গাছ সেটা বুঝতে পারে। শুধু তাই নয়, গাছ সেদিকে যাওয়ারও চেষ্টা করে। কাজেই একটা কিছু ব্যবস্থা করে যদি সেটা বুঝে নেয়া যায় তাহলে গাছকে সেদিকে যেতে সাহায্য করা যায়। গাছের টবটা থাকবে একটা গাড়ির উপর, গাড়ির কন্ট্রোল থাকবে গাছের উপর–