আমার খানিকক্ষণ সময় লাগে তার কথাটা বুঝতে। অবাক হয়ে বললাম, আপনি এত বছর ধরে ঢাকায় আছেন আর রমনা পার্ক চেনেন না?
সফদর আলী থতমত খেয়ে বললেন, কেমন করে চিনব?
আর সবাই যেভাবে চেনে, আমরা যেভাবে চিনেছি। পয়লা বৈশাখ কত সুন্দর গান হয় সেখানে, বিজ্ঞানী হয়েছেন দেখে এসবের খোজখবরও রাখবেন না?
আমার ধমক খেয়ে সফদর আলী একটু নরম হয়ে গেলেন। কেউ যখন আমার উপর কিছু একটা নিয়ে রেগে যায়, আমি তখন উল্টো তার উপর আরো বেশি রেগে যাওয়ার চেষ্টা করি সবসময়, তাহলে তার রাগ কমে আসে। সফদর আলীকে সহজ করানোর জন্যে বললাম, কী দেখলেন পার্কে?
তার মুখ খুশিতে ঝলমল করে ওঠে, একগাল হেসে বললেন, গাছ!
গাছ?
হ্যাঁ, গাছ। সফদর আলীর মুখে হাসি আর ধরে না।
আগে আপনি গাছ দেখেন নি?
দেখব না কেন, গাছ না দেখার কী আছে?
তাহলে?
এবারে অন্যরকমভাবে দেখলাম, কাছে এসে অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে, বলতে বলতে সফদর আলীর মুখে কেমন একটা অপার্থিব হাসি ফুটে ওঠে। গাছ নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাসে আমার একটু অবাক লাগে, বাংলাদেশের মানুষ গাছে গাছেই তো বড় হয়, সাহারা মরুভূমি থেকে এলে না হয় একটা কথা ছিল।
আপনি জানেন, সফদর আলী হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে বললেন, এক ধরনের গাছ আছে, সেটা লতার মতো। তার কোনো শক্ত কাণ্ড নেই, অন্য গাছ বেয়ে বেয়ে ওঠে–
সফদর আলী ঠাট্টা করছেন কি না বুঝতে পারলাম না, আমি তাঁর দিকে ভালো করে তাকালাম না, ঠাট্টা-তামাশার মানুষ সফদর আলী নন। সত্যিই তিনি লতানো গাছের কথা বলছেন। এমনভাবে বলছেন যেন এই প্রথম বার একটা লতানো গাছ দেখেছেন।
কোনো কোনো লতানো গাছ থেকে আবার শুড়ের মতো বের হয়, সেগুলো আবার এটা-সেটা আঁকড়ে ধরে উপরে উঠতে থাকে। মজার ব্যাপার জানেন, সেই শুডগুলো সবসময় একই দিকে পেঁচায়। তার উপর–
সফদর আলী এরপর টানা আধ ঘন্টা উচ্ছাসভরে গাছের কথা বলে গেলেন, আমাকে ধৈর্য ধরে শুনতে হল। গাছের পাতার রং সবুজ। কিন্তু ফুলগুলো সবুজ নয়, সেগুলো রঙিন, ফুল থেকে আবার ফল হয়, এই ধরনের কথাবার্তা। না শুনলেও আমার যে খুব ক্ষতি হত সেরকম বলব না।
সফদর আলীর সাথে এরপর বেশ অনেকদিন দেখা নেই। মাঝে মাঝে তিনি এরকম ড়ুব মারেন, আমার নিজেরও কাজকর্ম ছিল, তাই আর খোঁজখবর করি নি। গাছপালা নিয়ে তাঁর উচ্ছাস কমেছে কি না জানার জন্যে কৌতূহল ছিল। বিজ্ঞানী মানুষ, লোহালক্কড় নিয়ে কারবার, গাছপালা নিয়ে বেশিদিন ব্যস্ত থাকতে পারবেন না তাতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। তাই কাওরান বাজারে চায়ের দোকানে আবার যখন তাঁর সাথে দেখা, আমি একটু অবাক না হয়ে পারলাম না। টেবিলে নানারকম গাছের পাতা বিছানো, হাতে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে গাছের পাতাগুলো লক্ষ করছেন। হাতে একটা নোটবুক, একটু পরে পরে সেখানে তিনি কী যেন টুকে রাখছেন। পাশের চায়ের কাপে চা ঠাণ্ডা হচ্ছে, তাঁর চুমুক দেবার কথা মনে নেই। আমি সামনের চেয়ারে বসলাম, তিনি লক্ষ পর্যন্ত করলেন না। একটু কেশে ডাকলাম, সফদর সাহেব–
তিনি ভীষণ চমকে উঠে গাছের পাতাগুলো তাড়াতাড়ি ঢেকে ফেলতে চেষ্টা করলেন, হাতের ধাক্কায় চায়ের কাপ উল্টে সারা টেবিল চায়ে মাখামাখি হয়ে গেল। আমাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ও আপনি! আমি ভাবলাম–
কী ভাবলেন?
নাহ্, কিছু না। সফদর আলী তাঁর অভ্যাসমতো প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে সাবধানে টেবিল থেকে গাছের পাতাগুলো তুলে নোটবুকের ভেতর রাখতে রাখতে বললেন, জীবজন্তু থেকে গাছ আরো বেশি কাজের। গাছ নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে পারে।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না সফদর আলী কী বলতে চাইছেন। কল্পনা করার চেষ্টা করলাম, একটা গাছ নিজের খাবার নিজে তৈরি করছে, চুলোয় ভাত চাপিয়ে দিয়ে মাছ কুটতে বসেছে। দৃশ্যটা বেশিক্ষণ ধরে রাখা গেল না। একটু ইতস্তত করে বললাম, গাছ আবার নিজের খাবার নিজে তৈরি করে কী ভাবে? আমি যতদূর জানি মানুষ শুধু নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে পারে। সবাই অবশ্যি পারে না, আমি রান্না করলে সেটা–
ধেৎ! আমাকে থামিয়ে দিয়ে সফদর আলী বললেন, আমি কি রান্না করার কথা বলছি? আমি বলছি খাবার তৈরি করা। বুঝতে পারলেন না?
আমি মাথা নাড়লাম, সত্যিই বুঝি নি। সফদর আলী হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক আছে, বুঝিয়ে দিচ্ছি। মানুষ কী খায়?
সেটা নির্ভর করে কী রকম মানুষ, তার উপর। যাদের পয়সাকড়ি আছে তারা মাছ, মাংস, দুধ, ফলমূল খায়, যাদের নেই তারা ডাল-ভাত পেলেই খুশি।
ঠিক আছে, ডাল-ভাত দিয়ে শুরু করা যাক, আপনি ডাল-ভাত তৈরি করতে পারবেন?
না।
কিন্তু গাছ পারে, ডাল আর ভাত গাছ থেকেই এসেছে।
আমরা তো মাছও খাই, মাছ তো গাছ থেকে আসে না। দেখেছেন কখনো “মাছ গাছ”?
কিন্তু মাছ কী খেয়ে বড় হয়?
আমি একটু মাথা চুলকে বললাম, বড় মাছ ছোট মাছদের খায়।
ঠিক আছে, ছোট মাছরা কী খায়? খুঁজে দেখেন সেগুলো শ্যাওলাজাতীয় কোনো এক ধরনের গাছ খেয়ে বড় হচ্ছে। আপনি মাংস খান, মাংস কোথা থেকে এসেছে? গরু থেকে। গরু কী খেয়ে বড় হয়? ঘাস খেয়ে। আপনি যেটাই দেখবেন সেটাই ঘুরেফিরে গাছপালার উপর বেঁচে আছে। কিন্তু গাছপালা? তারা কী খেয়ে বড় হচ্ছে? পানি আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড। সূর্যের আলো ব্যবহার করে পানি আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড দিয়ে তৈরি করে কার্বোহাইড্রেড, সেটা দিয়ে সারা পৃথিবী বেঁচে আছে। পারবেন আপনি কার্বোহাইড্রেড তৈরি করতে?