সফদর আলীকে দরকার, তাঁকে পাওয়া মুশকিল বলে আমিও তাঁর কায়দায় তাঁকে একটা টেলিগ্রাম পাঠালাম, তাতে লেখা, রহস্য উদ্ঘাটল। গুলু গুলু গুলু গুলু কেন? সহজ সমাধান। কাওরান বাজার। সন্ধ্যা ছয়টা।
পরদিন সন্ধ্যা ছয়টার সময় কাওরান বাজারে সেই রেস্তরাঁয় গিয়ে দেখি সফদর আলী পাংশু মুখে বসে আছেন, আমাকে দেখে প্রায় ছুটে এলেন, গলা নামিয়ে বললেন, একটা ব্যাপার হয়েছে।
কি ব্যাপার?
আমার গবেষণা নিশ্চয়ই জানাজানি হয়ে গেছে, আমার পিছনে দেশী-বিদেশী এজেন্ট লেগে গেছে।
কী ভাবে জানলেন?
আমি যে আশ্চর্য-আশ্চর্য শব্দ করি সেটা পর্যন্ত জেনে গেছে। আজ একটা টেলিগ্রাম পেলাম, কে পাঠিয়েছে জানি না, লিখেছে রহস্য উদ্ঘাটন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি বুঝতে পারেন নি, এটা আমি পাঠিয়েছি।
আপনি! সফদর আলী মনে হল আকাশ থেকে পড়লেন, আপনি রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন?
হ্যাঁ।
তাঁকে দেখেই বুঝতে পারলাম তিনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না, একটু রেগে বললেন, টেলিগ্রাম করেছেন তো নাম লেখেন নি। কেন?
আপনিও তো আপনার টেলিগ্রামে নাম লেখেন না।
আমি যদি নাম না লিখি সেটা আমার ভুল। আমি একটা ভুল করি বলে আপনিও একটা ভুল করবেন?
এর উত্তরে আমি আর কী বলব?
সফদর আলী খানিকক্ষণ পর একটু শান্ত হয়ে বললেন, রহস্যটা বলেন, তাহলে শুনি।
আমি হাসি চেপে বললাম, বানরটাকে আপনি কেমন করে শেখান মনে আছে? পুরস্কার পদ্ধতি। যখনই বানর একটা ঠিক জিনিস করে আপনি তাকে একটা পুরস্কার দেন, একটা কলা বা কোনো একটা খাবার।
হ্যাঁ।
আসলে একই সময়ে বানরটাও আপনার উপরে পুরস্কার পদ্ধতি খাটিয়ে যাচ্ছে। আপনি যখন ঠিক জিনিসটা করেন বানরও তখন আপনাকে একটা পুরস্কার দেয়। সেটা হচ্ছে তার মনোেযোগ। বানরের কাছে কলাটা যত মূল্যবান আপনার কাছে বানরের মনোযোগ ঠিক ততটুকু মূল্যবান। আপনি প্রাণপণ চেষ্টা করেন বানরের মনোযোগের জন্যে, অনেক কিছু করতে করতে যখন হঠাৎ করে ঠিক জিনিসটা করে ফেলেন, বানর তখন পুরস্কার হিসেবে আপনাকে তার মনোযোগ দেয়।
সফদর আলী অবাক হয়ে বললেন, ঠিক জিনিসটা কি?
সে যেটা শুনতে চায়।
কী শুনতে চায় সে?
বানরটা যে বাসা থেকে এনেছি, সে বাসায় একটা ছোট বছরখানেকের বাচ্চা আছে, বানরটার সাথে তার খুব বন্ধুত্ব ছিল। বানরটার বাচ্চাটার জন্যে খুব মায়া জন্মেছিল, আপনার বাসায় আসার পর থেকে সে তাকে আর দেখে না। বানরটা নিশ্চয়ই বাচ্চাটাকে খুব দেখতে চাইছিল, তার গলার স্বর শুনতে চাইছিল। কাজেই আপনি যখনি সেই ছোট বাচ্চাটির মতো শব্দ করেন বা তার মতো লাফ দিয়ে হাততালি দেন, হামাগুড়ি দেন—সে খুশি হয়ে আপনাকে তার মনোযোগ দেয়।
সফদর আলী অবিশ্বাসের স্বরে বললেন, আপনি কী ভাবে জানেন?
আমি কাল জংবাহাদুরের মালিকের বাসায় গিয়েছিলাম, বাচ্চাটিকে দেখে এসেছি, বাচ্চাটি কিছু হলেই বলে, গুলু গুলু গুলু গুলু বা মুচি মুচি মুচি মুচি। জংবাহাদুরের মনোযোগের জন্যে এখন আপনিও নিজের অজান্তেই বলেন, গুলু গুলু গুলু গুলু। মুচি মুটি মুচি মুচি।
সফদর আলী বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে-আস্তে বললেন, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আসলে তা-ই হয়েছে। বানরটাকে মনোযোগ বাড়ানোর ওষুধ খাওয়াতে না পেরে নিজেই একটু চেখে দেখছিলাম, নিজের মনোযোগ তাই বেড়ে গিয়েছিল দশগুণ। তাই থেকে সফদর আলী আপন মনে কী একটা ভাবতে-ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন।
আমি বললাম, এখন যখন কারণটা জেনেছেন, একটু সতর্ক থাকবেন।
সফদর আলী আমার কথা শুনলেন বলে মনে হল না। আমি ডাকলাম একবার, কোনো সাড়া নেই। ঠাট্টা করার জন্যে গলা উঁচিয়ে বললাম, গুলু গুলু গুলু।
সফদর আলী ঠাট্টা-তামাশা বোঝেন কম, আমার কথা শুনে ভীষণ চমকে উঠে চায়ের কাপ উল্টে ফেললেন, আমার দিকে ঘুরে তাকালেন, আ – আস্তে তাঁর চোখ বড়-বড় হয়ে উঠতে থাকে।
আমি একটা নিঃশ্বাস ছাড়ি। ঠাট্টা-তামাশা বাড়ানোর একটা ওষুধ বের করতে পারলে মন্দ হত না, ডাবল ডোজ খাইয়ে দেয়া যেত সফদর আলীকে।
০৩. গাছগাড়ি
সফদর আলীর চোখ মুখ খুশিতে ঝলমল করছিল, আমাকে দেখে চোখ নাচিয়ে বললেন, বলেন দেখি আজ কোথায় গিয়েছিলাম?
আমি মাথা চুলকে বললাম, সিনেমা দেখতে?
ধুর! সিনেমা আবার মানুষ দেখে নাকি?
আমি এইমাত্র ম্যাটিনি শো’তে একটা প্রচণ্ড মারামারির সিনেমা দেখে এসেছি, তাই মন্তব্যটা কোনোমতে হজম করে বললাম, তাহলে কি নাটক?
আরে না না, ওসব নাটকফাটক আমি দেখি না!
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, তাহলে কি কোনো কনফারেন্স, যেখানে সব বিজ্ঞানীরা এসে–
সফদর আলী হো-হো করে হেসে উঠলেন, তিনি জোরে হাসেন কম, তাই আমি একটু অবাক হয়ে যাই। হাসি থামিয়ে বললেন, বিজ্ঞানীরা আমাকে তাদের কনফারেন্সে ঢুকতে দেবে কেন? আমি কোথাকার কে?
আমি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছিলাম, সফদর আলী আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, পারলেন না তো বলতে! রমনা পার্কে গিয়েছিলাম।
রমনা পার্ক?
হ্যাঁ, ঐ যে শিশুপার্কের পাশ দিয়ে গিয়ে—
হ্যাঁ, চিনি আমি।
চেনেন? সফদর আলী খুব অবাক হলেন বলে মনে হল।
চিনব না কেন? রমনা পার্ক না চেনার কী আছে, যখন কলেজে পড়তাম, নতুন সিগারেট খাওয়া শিখে
আপনি রমনা পার্ক চেনেন অথচ আমাকে একবার বললেন না?
আমি অবাক হয়ে বললাম, কী বললাম না?
রমনা পার্কের কথা।