পরদিন অফিস থেকে বাসায় এসে দেখি আবার টেলিগ্রাম, না-খুলেই বুঝতে পারি এটা সফদর আলীর। সত্যি তাই, ভেতরে লেখা :
মহা আশ্চর্য ব্যাপার। আপনি ঠিক। আমি বলি, গুলু গুলু গুলু গুলু এবং মুচি মুচি মুচি মুচি। কাওরান বাজার। সন্ধ্যা ছয়টা। তবু ভালো শেষ পর্যন্ত সফদর আলী নিজেই ধরতে পেরেছেন যে, তিনি আশ্চর্য-আশ্চর্য সব শব্দ করছেন। এক জন মানুষ যখন না জেনে কিছু করে, তার জন্যে তাকে দায়ী করা খুব মুশকিল। কে জানে তিনি বুঝতে পেরেছেন কি না, কেন এরকম করছেন, আমার কৌতূহল আর বাঁধ মানছিল না।
ঠিক পাঁচটার সময় আমার ছোট ভাইঝি টেবিল থেকে উল্টে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলল। এটি নতুন কোনো ব্যাপার নয়। প্রতি সপ্তাহে না হলেও মাসে অন্তত এক বার করে তার এধরনের কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটে। তাকে নিয়ে দৌড়ালাম ডাক্তারের কাছে, ডাক্তার তার মাথাটা খানিকটা কামিয়ে সেখানে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। তাকে নিয়ে ফিরে আসার আগে জিজ্ঞেস করলাম, তার কেমন লাগছে। সে বলল, তার বেশি ভালো লাগছে না, তবে যদি খানিকটা আইসক্রিম খায় তবে মনে হয় ভালো লাগতে পারে। এরকম একটা সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দেবার পর তাকে আইসক্রিম না খাইয়ে বাসায় আনি কেমন করে? আইসক্রিমের দোকান খুঁজে আইসক্রিম কিনে দিয়ে যখন বাসায় ফিরে এলাম, তখন ছয়টা বেজে গেছে। কাওরান বাজারে যেতে যেতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যাবে। সফদর আলীর সময় নিয়ে বাড়াবাড়ি করার অভ্যাস, কাজেই আজ যে তার সাথে দেখা হবে না তা বলাই বাহুল্য। আমি তবু তাড়াহুড়ো করে বের হলাম। চায়ের দোকানে গিয়ে সত্যিই তাঁকে পেলাম না। দোকানি বলল, খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে তিনি নাকি বেরিয়ে গেছেন। তাঁর বাসায় গিয়ে এখন আর লাভ নেই। এরকম সময়ে তিনি কখনো বাসায় থাকেন না। আমি এককাপ চা অর্ডার দিয়ে পুরো ব্যাপারটা ভাবতে বসি। কী হতে পারে ব্যাপারটা? কেন সফদর আলী হঠাৎ করে নিজের অজান্তে এরকম আশ্চর্য শব্দ করা শুরু করেছেন? নিশ্চয়ই বানরটার সাথে একটা সম্পর্ক আছে। হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে হলে আগে বানরের ইতিহাসটা জানতে হবে। আমার তখন শান্তিনগরের সেই ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ল, যার কাছ থেকে বানরটা এনেছিলাম, তিনি হয়তো কোনো একটা সমাধান দিতে পারেন। আমি তাড়াতাড়ি করে চা শেষ করে তাঁর বাসায় রওনা দিলাম, কপাল ভালো থাকলে আজকেই তাকে পেয়ে যেতে পারি।
বাসাটা আবার খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগল, এসব ব্যাপারে আমার স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল। দরজার কড়া নাড়তেই ভদ্রলোক এসে দরজা খুলে দিলেন। আমাকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, আরে আসেন, আসেন। কী খবর আপনার? কয়দিন থেকেই ভাবছি জংবাহাদুরের খোঁজ নিই, ভালোই হল আপনি এসে গেলেন। তারপর চিৎকার করে ভেতরে বললেন, এই, চা দিয়ে যা বাইরে।
আমি ঘরে গিয়ে বসি। ভদ্রতার কথাবার্তা বলতে বলতে বানরের ইতিহাসটা জিজ্ঞেস করার জন্যে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকি। সফদর আলীর অবস্থাটা এখন। তাঁর কাছে গোপন রাখব বলে ঠিক করলাম, শুনে ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ঘাবড়ে যাবেন। ভদ্রলোক বেশ কথা বলেন, জংবাহাদুরের খোঁজখবর নিয়ে আবার তাঁর প্রিয় বিষয়বস্তু, মানুষের নামের সাথে চেহারার সামঞ্জস্য নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিলেন। ভেতর। থেকে একসময় সর-ভাসা চা এবং সিঙাড়া এল। আমি সিঙাড়ায় কামড় দিয়ে চা তুলে এক চুমুক খেয়েছি, হঠাৎ ভদ্রলোকের ঘরের ভেতর থেকে শব্দ ভেসে এল, গুলু গুলু গুলু।
চমকে উঠে বিষম খেলাম আমি, গরম চা দিয়ে তালু পুড়ে গেল। কিন্তু আমার সেটা নিয়ে ব্যস্ত হবার মতো অবস্থা নেই। কান খাড়া করে রাখি আমি, আর তখন সত্যি আবার শুনলাম, গুলু গুলু গুলু গুলু।
আমি চোখ বড় বড় করে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শুনলাম, মুচি মুচি মুচি মুচি। তারপর হঠাৎ পর্দা ঠেলে বছরখানেকের একটা ফুটফুটে বাচ্চা থপ থপ করতে করতে ঘরে এসে হাজির হল। আমাকে অপরিচিত দেখে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়। তারপর আবার মুখ হাসি হাসি করে আধো আধো গলায় বলল, গুলু গুলু গুলু গুলু।
পুত্রস্নেহে বাবার চোখ কোমল হয়ে ওঠে, তিনি হাত নেড়ে ডাকতেই খুশিতে ছোট ছোট লাফ দিয়ে হাততালি দিতে থাকে, ঠিক সফদর আলী যেভাবে লাফিয়েছিলেন। বাচ্চাটি এখনো ভালো করে হাঁটতে শেখে নি, তাই টাল সামলাতে না পেরে হঠাৎ পড়ে গেল, পড়ে গিয়েও তার খুশি, কে, সেভাবেই হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল তার বাবার দিকে, ঠিক সফদর আলীর মতো।
আমি রহস্য ভেদ করতে গিয়ে আরো বড় রহস্যে পড়ে গেলাম। সফদর আলী যেসব অদ্ভুত শব্দ করছেন সেগুলো এই বাচ্চাটির আধো আধো বুলি, যেসব লাফ-ঝাঁপ বা হামাগুড়ি দিচ্ছেন সেগুলো এই বাচ্চাটির নিখুঁত অনুকরণ। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, তিনি এই বাচ্চাটির অস্তিত্বের কথা পর্যন্ত জানেন না! কেমন করে এটা সম্ভব?
ভদ্রলোকের বাসায় আরো কিছুক্ষণ থাকলাম, কিন্তু আলাপ আর জমল না। কেমন করে জমবে, আমার মাথায় তখন সফদর আলীর কথা ঘুরছে। বাসায় ফিরে আসার সময় রিকশায় বসে আমি পুরো ব্যাপারটি ভাবতে থাকি, ভাবতে ভাবতে মনে হল পুরো মাথাটা ফেটে যাবে, কিন্তু কোনো কূল-কিনারা পেলাম না। বেশি ভাবনা-চিন্তা করে আমার অভ্যাস নেই, চেষ্টা করলে সহজেই মাথা ধরে যায়। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে আমি হাল ছেড়ে দিয়ে যেই রিকশাওয়ালার সাথে গল্প শুরু করলাম, ঠিক তক্ষুনি হঠাৎ করে সব রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেল—একেবারে পানির মতো।