গুলু গুলু গুলু গুলু।
আমি চমকে উঠি, সফদর আলী আবার ওরকম শব্দ করছেন! আমি ভান করলাম। নি শুনি নি, চুপচাপ হাঁটতে থাকি। সফদর আলী আবার বললেন, গুলু গুলু গুলু গুলু।
আমি তার দিকে তাকাতেই তিনি সহজ স্বরে বললেন, একটা ব্যাপারে মানুষের চেয়ে বানরের সুবিধে আছে, সেটা হচ্ছে তার পা। মানুষ তার পা দিয়ে কিছু ধরতে পারে না, বানর পারে।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, আপনি একটু আগে ওরকম শব্দ করছিলেন কেন?
সফদর আলী অবাক হয়ে বললেন, কী রকম শব্দ?
আমি গলা নামিয়ে বললাম, গুলু গুলু গুলু গুলু।
সফদর আলী এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, যেন আমি পাগল হয়ে গেছি। কিন্তু এবারে কোনো ভুল নয়, আমি স্পষ্ট শুনেছি। আমি কী মনে করে সফদর আলীকে বেশি ঘাঁটালাম না, চিন্তিতভাবে হাঁটতে থাকি। আর্ট কলেজের সামনে এসে আমি একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, হঠাৎ শুনি সফদর আলী আবার অদ্ভুত গলার স্বরে বলছেন, মুচি মুচি মুচি মুচি–
আমি ভীষণ চমকে উঠলেও ভান করলাম যেন তাঁর কথা শুনতে পাই নি, সফদর আলী বলতেই থাকেন, মুচি মুচি মুচি মুচি।
আমি নিঃসন্দেহ হয়ে তাঁর দিকে তাকাতেই তিনি সহজ স্বরে বললেন, লেজ জিনিসটা আসলে খারাপ নয়। ওটা একটা বাড়তি হাতের মতো। মানুষের লেজ থাকলে মন্দ হত না।
আমি বললাম, আপনি জানেন, একটু আগে আপনি বলছিলেন, মুচি মুচি মুচি মুচি।
আমি?
হ্যাঁ, আপনি।
কী বলছিলাম?
মুচি মুচি মুচি মুচি।
সফদর আলী অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বলছেন আপনি!
হ্যাঁ, আমি শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলব কেন?
আপনার অফিসের কাজকর্মের চাপ নিশ্চয়ই খুব বেড়েছে, সফদর আলী হাসি গোপন করার চেষ্টা করে বললেন, আপনার কয়দিন বিশ্রাম নেয়া দরকার। খুব চাপে থাকলে মানুষের বিভ্রম হয়, কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা গুলিয়ে ফেলে। আপনি বাসায় গিয়ে শুয়ে থাকেন।
আমি তাঁর কথার প্রতিবাদ করতে গিয়ে থেমে গেলাম, এর মধ্যে নিশ্চয়ই একটা রহস্য আছে। আমি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত যে সফদর আলী নিজের অজান্তে এরকম অদূত শব্দ করেন। কিন্তু কেন? প্রত্যেক বার তিনি শব্দ করেছেন, যখন আমি একটু অন্যমনস্ক হয়েছি তখন। ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে আমি খানিকক্ষণ তাঁর সাথে কথা বলে আবার অন্যমনস্ক হয়ে যাবার ভান করলাম। আর সত্যি সত্যি তিনি অদ্ভুত শব্দ করা শুরু করলেন। প্রথমে বললেন, গুলু গুলু গুলু গুলু। খানিকক্ষণ পরে বললেন, মুচি মুচি মুচি মুচি। আমি তবু অন্যমনস্ক হয়ে থাকার ভান করি। তখন হঠাৎ সফদর আলী ছোট ছোট লাফ দিয়ে হাততালি দিতে শুরু করলেন। ঠিক এই সময়ে এক জন সামনে দিয়ে আসছিল, রাস্তায় বয়স্ক এক জন মানুষ এভাবে লাফ দিচ্ছে দেখলে সে কী ভাববে? আমি তাড়াতাড়ি সফদর আলীর দিকে তাকাই। সাথে সাথে তিনি ভালোমানুষের মতো বললেন, বিবর্তনটা যদি একটু অন্যরকমভাবে হত, তাহলে হয়তো আজ মানুষের জায়গায় বানর পৃথিবীতে রাজত্ব করত, আর মানুষ গাছে গাছে ঘুরে বেড়াত। কী বলেন?
আমি তাঁর কথায় সায় দিয়ে কিছু একটা বললাম, কিন্তু আমার মাথায় সফদর লীর এই আশ্চর্য আচরণের কথা ঘুরতে থাকে। এর ব্যাখ্যা পাই কোথায়? অন্যমনস্ক হওয়ার ভান করে থাকলে তিনি শেষ পর্যন্ত কী করেন দেখার জন্যে আমি একটু অপেক্ষা করি। যখন দেখলাম রাস্তায় আশেপাশে কেউ নেই, তখন আবার আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাবার ভান করলাম। খানিকক্ষণের মধ্যেই সফদর আলী আশ্চর্য শব্দ করা শুরু করলেন। প্রথমে বললেন, গুলু গুলু গুলু গুলু। তাতে কাজ না হওয়ায় ললেন, মুচি মুচি মুচি মুচি, খানিকক্ষণ পর ছোট ছোট লাফ দিতে শুরু করলেন। সাথে হাততালি। আমি তবুও জোর করে অন্যমনস্ক হয়ে থাকার ভান করতে থাকি। এখন হঠাৎ তিনি যেটা করলেন, আমি সেটার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না। রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে খানিক দূর হামাগুড়ি দিয়ে গেলেন, তারপর উঠে মুখে থাবা দিয়ে বললেন, লাবা লাবা লাবা লাবা।
আমি বিস্ফোরিত চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তিনি স্বাভাবিক স্বরে বললেন, কী হল আপনার?
কেন?
এরকম হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন?
আমি উত্তরে আর কী বলব? ঠিক করলাম, ব্যাপারটা আজকে তাঁর কাছে চেপে যাব। একটু ভেবে দেখতে হবে রহস্যটা কি। সফদর আলীকে একটা দায়সারা উত্তর দিয়ে তাঁর কাছে বিদায় নিয়ে বাসায় রওনা দিলাম। ফিরে আসার সময় রিকশায় বসে ব্যাপারটা ভেবে দেখার চেষ্টা করি। সফদর আলীর এই অদ্ভুত ব্যবহারের সাথে নিশ্চয়ই বানরটার কোনো সম্পর্ক আছে। বানরটাকে কাজকর্ম শেখানো শুরু করার পর থেকেই এটা শুরু হয়েছে। অন্যমনস্ক হলেই মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে তিনি এটা করেন, প্রথম প্রথম বানরটিও নাকি অন্যমনস্ক থাকত। দুটির মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক আছে? নাকি বানরের সাথে থাকতে থাকতে তার স্বভাবও বানরের মতো হয়ে যাচ্ছে? আর অন্য সব ব্যাপারে তিনি আগের মতোই আছেন। কাজেই বেশি পরিশ্রমে পাগলামি দেখা দিচ্ছে, সেটাও তো হতে পারে না। আমি কিছুই ভেবে পেলাম না। আগে নাকি কাপালিকরা বানরকে দিয়ে কী একধরনের সাধনা করত। কে জানে এটি সেরকম কোনো বানর কি না। এর মাঝে জাদুটোনার ব্যাপার আছে কি না কে বলবে। ভেবে ভেবে আমি কোনো কূল-কিনারা পেলাম না। ভাবনা-চিন্তা করে আমার অভ্যাস নেই, খানিকক্ষণের মধ্যেই তাই মাথা ধরে গেল, বাসায় এসে দুটো অ্যাসপিরিন খেয়ে তবে রক্ষা।