সপ্তাহখানেক পর আমার সফদর আলীর সাথে দেখা, সফদর আলী হচ্ছেন এমন এক জন মানুষ যার মুখ দেখেই মনের কথা পরিষ্কার বলে দেয়া যায়। আজ যেরকম তাঁকে দেখেই বুঝতে পারলাম, তাঁর কাজকর্ম ভালোই হচ্ছে, তিনি তাঁর বানরকে নিয়ে মোটামুটি সন্তুষ্ট। ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, তার চোখের কোনা একটু কুঁচকে আছে, যার অর্থ কোনো একটা কিছু নিয়ে তিনি একটু চিন্তিত। আমাকে দেখে তিনি খুশি হয়ে উঠলেন, হাসিমুখে বললেন, বানর স্ক্রু-ড্রাইভার ধরে কেমন করে জানেন?
আমি জানতাম না, তাই তিনি পকেট থেকে একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে দেখালেন। ব্যাপারটি তাঁর কাছে এত হাস্যকর যে তিনি কিছুতেই আর হাসি থামাতে পারেন না। আমি চুপ করে বসে রইলাম, কারণ আমিও ঠিক ওভাবে স্ক্রু-ড্রাইভার ব্যবহার করি। তাঁর হাসি একটু কমে এলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বানরের ট্রেনিং কেমন হচ্ছে?
ভালো, বেশ ভালো। প্রথমে একটু অসুবিধে হয়েছিল। কি অসুবিধে?
মনোযোগের অভাব, কিছুতেই জংবাহাদুরের মনোযোগ নেই, শুধু গালে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আপনার না একটা মনোযোগ বাড়ানোর ওষুধ আছে?
সফদর আলী মাথা চুলকে বললেন, হ্যাঁ আছে, কিন্তু সেটা খেতে এত খারাপ যে কিছুতেই জংবাহাদুরকে খাওয়াতে রাজি করাতে পারলাম না।
এখন মনোযোগ দিচ্ছে?
হ্যাঁ, এক সপ্তাহ পরে গত কাল প্রথম সে মনোেযোগ দিয়েছে। হঠাৎ করে মনোযোগ দিল।
হঠাৎ করে?
হ্যাঁ, হঠাৎ করে। এখনো মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যায়, আবার হঠাৎ করে মনোযোগ ফিরে আসে।
বানরের মনস্তত্ত্ব আমার জানা নেই। তাই এক সপ্তাহ অন্যমনস্ক থেকে হঠাৎ করে মনোযোগ দেয়ার পিছনে কী কারণ থাকতে পারে আমি বুঝতে পারলাম না। হয়তো নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হতে সময় নিয়েছে, হয়তো ভেবেছিল একটা সাময়িক ব্যাপার, আবার সে তার আগের বাসায় ফিরে যাবে। হয়তো তার মন খারাপ, বানরের মন খারাপ হতে পারে না এমন তো কেউ বলে নি।
গুলু গুলু গুলু গুলু—আমি হঠাৎ চমকে উঠে শুনি, সফদর আলী আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত স্বরে বলছেন, গুলু গুলু গুলু গুলু।
থতমত খেয়ে বললাম, কী বললেন?
সফদর আলী পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কি বললাম?
আমি ইতস্তত করে বললাম, হ্যাঁ, মানে আপনি কেমন একটা শব্দ করছিলেন না?
আমি? সফদর আলী আকাশ থেকে পড়লেন, আমি শব্দ করছিলাম? হ্যাঁ। কী রকম শব্দ?
আমি এদিকসেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে তাঁকে অনুকরণ করে বললাম, গুলু গুলু গুলু গুলু।
শুনে সফদর আলীর হাসি দেখে কে। পেট চেপে হাসতে হাসতে তাঁর চোখে প্রায় পানি এসে গেল। কোনোমতে বললেন, আমি ওরকম শব্দ করেছি? আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে যে রেস্টুরেন্টে লোকজনের মাঝে বসে বসে ওরকম শব্দ করব?
আমি প্রতিবাদ করতে পারলাম না। সত্যিই তো, এক জন বয়স্ক মানুষ হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই কেন ওরকম একটা জিনিস বলবে? তা হলে কি আমি ভুল শুনেছি? কিন্তু সেটাও তো হতে পারে না, আমি স্পষ্ট শুনলাম তিনি বললেন—গুলু গুলু গুলু গুলু। আমি ব্যাপারটি নিয়ে বেশি মাথা ঘামালাম না, সবাই জানে বিজ্ঞানীরা একটু খেয়ালি হয়, আর সফদর আলী তো এক ডিগ্রি উপরে।
সপ্তাহখানেক পরের কথা, রিকশা করে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি রেসকোর্সের পাশ দিয়ে সফদর আলী হেঁটে যাচ্ছেন, আমি রিকশা থামিয়ে ডাকলাম, সফদর সাহেব।
সফদর আলী ঘুরে তাকিয়ে আমাকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, কোথায় যাচ্ছেন?
বাসায়।
এখনি বাসায় গিয়ে কী করবেন? আসেন হাঁটি একটু। হাঁটলে পা থেকে রক্ত সরবরাহ হয়, খুব ভালো কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম।
কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়ামের লোভে নয়, সফদর আলীর সাথে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলার জন্যেই আমি রিকশা থেকে নেমে পড়ি। দু’জন রেসকোর্সের পাশ দিয়ে। হাঁটতে থাকি। চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে, বছরের এই সময়টা এত চমৎকার যে বলার নয়। আমি সফদর আলীকে জিজ্ঞেস করলাম, জংবাহাদুরের কী খবর? কাজকর্মে মনোযোগ দিয়েছে?
হ্যাঁ, দিচ্ছে, একটু ইতস্তত করে যোগ করলেন, মাঝে মাঝে হঠাৎ করে এখনও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, আবার হঠাৎ করে মনোযোগ ফিরে আসে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। গত সপ্তাহে তাকে সন্ডারিং করা শিখিয়েছি।
সত্যি?
হ্যাঁ, চমৎকার সল্ডারিং করে।
বাহ!
এখন সার্কিট বোর্ড তৈরি করা শেখাচ্ছি। আলট্রা ভায়োলেট রে দিয়ে এক্সপোজ করে ফেরিক ক্লোরাইড নিয়ে “এচ” করতে হয়, ঠিকমতো না করলে বেশি না হয়ে কম হয়ে যায়, নানা ঝামেলা তখন।
আমি কিছু না বুঝে বললাম, ও, আচ্ছা।
ফেরিক ক্লোরাইড জিনিসটা ভালো না, আরেকটা কিছু বের করা যায় কি না দেখতে হবে।
আমি এসব রাসায়নিক ব্যাপার কিছুই বুঝি না। আমার এক ভাগ্নে একদিন কথা নেই বার্তা নেই আমার ধোয়া শার্টে লাল রং ঢেলে দিল, আমি তো রেগে আগুন, কিন্তু কী আশ্চর্য, দেখতে-দেখতে লাল রং উবে আবার ধবধবে সাদা শার্ট, লাল রঙের চিহ্নমাত্র নেই! আমি তো ভারি অবাক, আমার ভাগ্নে তখন বুঝিয়ে দিল, এটা নাকি কী একটা রাসায়নিক জিনিস, বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে রংটা উবে যায়। আমি তখন আমার ভাগ্নেকে বললাম, আমাকে এক বোতল বানিয়ে দিতে, অফিসে বড় সাহেবের গায়ে ঢেলে মজা দেখাব। আমার সেই ভাগ্নে প্রচণ্ড পাজি, একটা বোতলে খানিকটা লাল কালি ভরে দিয়ে দিল। আমি তো কিছু জানি না, অফিসে গিয়ে সবার সামনে বড় সাহেবের নতুন শার্টে সেই লাল রং ঢেলে দিলাম, এক মিনিট দুই মিনিট করে দশ মিনিট পার হয়ে গেল, রং উবে যাওয়ার কোনো চিহ্ন নেই, বরং আরো পাকা হয়ে বসে গেল। সে কী কেলেঙ্কারি, চিন্তা করে এখনো আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।