জংবাহাদুরকে নিয়ে বের হতেই এই এলাকার লোকজন তার নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়, বোঝাই যাচ্ছে সে এই এলাকার অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র। জংবাহাদুরও কাউকে সালাম কাউকে হ্যাট খুলে সম্ভাষণ আবার কাউকে দাঁত বের করে ভেংচি কেটে প্রত্যুত্তর দেয়। আমার একটু অস্বস্তি লাগতে থাকে। তাই প্রথম রিকশাটা পেয়ে। দরদাম না করেই জংবাহাদুরকে নিয়ে উঠে পড়লাম। আমি আগে কখনো পশুপাখি। নাড়াচাড়া করি নি, তাই একটু ভয় ভয় করছিল, বানরটা যদি হঠাৎ করে খামচে দেয় ?
জংবাহাদুরকে নিয়ে রিকশা করে যাওয়াটা খুব উপভোগ্য ব্যাপার নয়। প্রথমে রিকশাওয়ালা জানতে চাইল আমি কত দিন থেকে বানরের খেলা দেখাই এবং এতে আমার কেমন উপার্জন হয়। আমি তাকে খুশি করার মতো উত্তর দিতে পারলাম না। রাস্তায় লোকজন, বিশেষ করে বাচ্চারা আমাকে “বানরওয়ালা” বলে ডাকতে থাকে। রাজারবাগের মোড়ে রিকশার দিকে একটা পাকা কলা ছুটে এল। সময়মতো মাথা নিচু করায় বলাটা আমার মাথায় না লেগে রিকশার পিছন দিকে গিয়ে লাগল। আমি আমার জানা সমস্ত দোয়া-দরুদ পড়তে থাকি। আজ অক্ষত শরীরে শ্যামলীতে সফদর আলীর বাসায় পৌঁছুতে পারলে কাল দুই টাকা দান করে দেব বলে মানত করে ফেললাম।
ফার্মগেটের কাছে, যেখানে লোকজনের ভিড় সবচেয়ে বেশি এবং যেখানে লোকজন সবচেয়ে বেশি উৎসাহ নিয়ে আমাকে এবং জংবাহাদুরকে ডাকাডাকি করতে থাকে, সেখানে আমাদের রিকশার টায়ার ফেটে গেল। চার বছর আগে আরামবাগে এক জন ছোরা দেখিয়ে আমার মানিব্যাগে টাকা এত কম কেন সেটা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করার সময়েও আমি এত ভয় পাই নি। রিকশা থেমে যেতেই আমাদের ঘিরে একটা ছোট ভিড় জমে যায়। তার ভিতর থেকে এক জন দুর্ধর্ষ ধরনের বাচ্চা জংবাহাদুরের লুঙ্গির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা লেজ ধরে টানার চেষ্টা করতে থাকে। আমি রিকশার ভাড়া মিটিয়ে আরেকটা খালি রিকশা খুঁজতে থাকি, কিন্তু আমার সমস্ত পাপকর্মের প্রতিফল হিসেবে একটিও খালি রিকশা বা স্কুটার দেখা গেল না। আমি আরেকটা রিকশা না পাওয়া পর্যন্ত এই রিকশা থেকে নামতে চাইছিলাম না, কিন্তু এক জন পুলিশ এসে বলল, রাস্তায় বানরের খেলা দেখানো বেআইনি এবং আমি যদি একান্তই খেলা দেখাতে চাই তাহলে আমাকে রাস্তার পাশে খালি জায়গাটায় যেতে হবে। তাকে ব্যাপারটা বোঝানোর আগেই সে আমাকে এবং আমাদের ঘিরে থাকা লোকজনকে ঠেলে-ঠেলে ফাঁকা জায়গাটিতে নিয়ে যায়। আমি কিছু বোঝার আগেই লোকজন। আমাদের ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। শুধু তাই নয়, পুলিশটি সামনের লোকজনদের বসিয়ে দিয়ে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে পড়ে। আমি তখন টপটপ করে ঘামছি, কোনোমতে ভাঙা গলায় বললাম, দেখেন, আমি বানরের খেলা দেখাই না, এটা আরেক জনের বানর
লোকজনের উল্লাসধ্বনিতে আমার কথা চাপা পড়ে যায়, আমার কথায় এত আনন্দের কী থাকতে পারে আমি বুঝতে পারলাম না, তখন আমার জংবাহাদুরের দিকে চোখ পড়ে। সে তার টিনের বাক্স খুলে জিনিসপত্র বের করা শুরু করেছে, একটা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ম্যাচ দিয়ে সেটা জ্বালিয়ে দু’টি লম্বা টান দিয়ে সে খেলা শুরু করে দেয়। প্রথমে একটা ড়ুগড়ুগি বের করে বাজাতে থাকে, তারপর এক কোনা থেকে ছুটে এসে শূন্যে দু’টি ডিগবাজি খেয়ে নেয়। লোকজন যখন হাততালি দিতে ব্যস্ত, তখন সে যে ছেলেটি তার লেজ ধরে টানার চেষ্টা করেছিল তাকে খুঁজে বের করে তার কান ধরে মাঝখানে টেনে এনে গালে প্রচণ্ড চড় কষিয়ে দেয়। লোকজনের উল্লাসধ্বনির মাঝে ছেলেটা প্রতিবাদ করার সাহস পেল না। মুখ চুন করে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে। এরপর জংবাহাদুরের আসল খেলা শুরু হয়, তার খেলা সত্যি দেখার মতো। বিভিন্ন রকম শারীরিক কসরত, মানুষের অনুকরণ, বিকট মুখভঙ্গি, উৎকট নাচ, কী নেই! শুধু তাই নয়, খেলার ফাঁকে ফাঁকে সে ক্রমাগত তার ড়ুগড়ুগি বাজিয়ে ভিড় আরো বাড়িয়েই যায়। আমি বোকার মতো মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকি আর প্রাণপণ দোয়া করতে থাকি পরিচিত কেউ যেন আমাকে দেখে না ফেলে। খোদা আমার দেয়া শুনবে, আমার নিজের উপর সেরকম বিশ্বাস ছিল। না, তাই যখন ভিড়ের মধ্যে আমাদের অফিসের বড় সাহেবকে আবিষ্কার করলাম, তখন বেশি অবাক হলাম না। খেলা শেষ হতেই জংবাহাদুর তার টুপি খুলে পয়সা আদায় করা শুরু করে, আমি নিষেধ করার সুযোগ পেলাম না। লোকজন পয়সাকড়ি বেশ ভালোই দিল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি বড় সাহেব একটা আস্ত আধুলি দিয়ে দিলেন। জংবাহাদুর খুচরা পয়সাগুলো রুমালে বেঁধে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। পরে গুনে দেখেছিলাম, মানতের দুই টাকা দেওয়ার পরেও দু’টি অচল সিকিসহ প্রায় সাড়ে তিন টাকা রয়ে গিয়েছিল।
সেদিন সফদর আলীর বাসায় জংবাহাদুরকে পৌঁছে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে আর যা-ই করি, কখনো বানর নিয়ে রাস্তায় বের হব না। বানরের খেলা দেখানো নিয়ে উত্তেজনা কমতে-কমতে প্রায় সপ্তাহখানেক লেগে গেল। ফার্মগেটের মোড়ে সেদিন আমাকে কত মানুষ দেখছিল তার হিসেব নেই। সবাই বাসায় এসে সেটা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে গেছে। আমি ব্যাপারটি যতই বোঝানোর চেষ্টা করি, কেউ আর বুঝতে চায় না। আমার মা এখনো একটু পরে পরে বলেন, ছি ছি ছি, তোর নানা এত খান্দান বংশের লোক, আর তার নাতি আজ রাস্তায় বানরের খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। অফিসের বড় সাহেবকে নিয়েও মুশকিল, একটু পরে-পরে সবার সামনে আমাকে প্রশংসা করে বলেন, আমার মতো স্বাধীনচেতা মানুষ তিনি নাকি জীবনে দেখেন নি। অফিসের বেতন যথেষ্ট নয় বলে বিকেলে আমার বানরের খেলা দেখিয়ে পয়সা উপার্জনের সৎসাহস দেখে তিনি নাকি মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁকে অনেক কষ্ট করেও ব্যাপারটি পুরোপুরি বোঝানো গেল না। বড় সাহেবদের মাথা একটু নিরেট হয়, কোনো কিছু একটা ঢুকে গেলে সেটা আর বের হতে চায় না।