অনিক লুম্বা আমার কবিতা শুনে হি হি করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি। মহিলা মশারা যেন ঠিক করে বাচ্চাকাচ্চা দিতে পারে সেই জন্যে আমাকে এই কাচের ঘরে রক্ত সাপ্লাই দিতে হয়।
সুর্বনাশ! আমি আঁতকে উঠে বললাম, বুলেন কী আপনি? কার রক্ত দেন এখানে?
অনিক লুম্বা আমাকে শান্ত করে বলল, না, না, আপনার ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। এখানে আমি মানুষের রক্ত দেই না। কসাইখানা থেকে গরু-মহিষের রক্ত নিয়ে এসে সেটা দিই। খুব কায়দা করে দিতে হয়, না হলে খেতে চায় না।
গরু-মহিষের রক্ত খায় মশা? আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেন্স করলাম, মানুষের রক্তের স্বাদ একবার পেয়ে গেলে তখন কি আর গরু-মহিষের রক্ত খেতে চাবে?
আসলে মশার সবচেয়ে পছন্দ মহিষের রক্ত। তারপর গরু, তারপর মানুষ।
তাই নাকি? মশার চোখে আমরা মহিষ এবং গরু থেকেও অধম?
অনিক লুম্বা হাসল, বলল, ঠিকই বলেছেন। মশাই ঠিক বুঝেছে। আমরা আসলেই মহিষ এবং গরু থেকে অধম।
কাচের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ কোটি মশাকে কিলবিল কিলবিল করতে দেখে এক সময় আমার কেমন জানি গা গুলাতে শুরু করল। আমি বললাম, অনেক মশা দেখা হল। এখন যাই।
চলেন। বলে অনিক লুম্বা ঘরের লাইট নিবিয়ে আমাকে নিয়ে বের হয়ে এল।
বের হয়ে আসতে আসতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমি এখনো একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না।
কোনটা বুঝতে পারলেন না?
মশার চাষ করছেন বুঝতে পারলাম, কিন্তু গবেষণাটা কী?
খুব সহজ। অনিক লুম্বা মুখ গম্ভীর করে বলল, রক্ত ছাড়া অন্য কিছু খেয়ে মহিলা মশারা বাচ্চার জন্ম দিতে পারে কিনা।
তাতে লাভ?
বুঝতে পারছেন না। তখন মশারা আর মানুষকে কামড়াবে না। সেই অন্য কিছু খেয়েই খুশি থাকবে। মশা যদি মানুষকে না কামড়ায় তা হলে তাদের ম্যালেরিয়া ফাইলেরিয়া ডেঙ্গু এই রোগও হবে না।
অনিক লুম্বার বুদ্ধি শুনে আমি চমৎকৃত হলাম। বললাম, মশা যদি মানুষকে না কামড়ায় তা হলে মানুষ মশা নিয়ে বিরক্ত হবে না।
ঠিকই বলেছেন।
জোনাকি পোকা কিংবা প্রজাপতি এগুলোকে নিয়ে মানুষ কত কবিতা লিখেছে, তখন মশা নিয়েও কবিতা লিখবে।
অনিক লুম্বা ভুরু কুঁচকে বলল, সত্যি লিখবে?
অবশ্যই লিখবে। জীবনানন্দ না মরণানন্দ নামে একজন কবি আছে সে লাশকাটা ঘরের উপরে কবিতা লিখে ফেলেছে, সেই তুলনায় মশা তো অনেক সম্মানজনক জিনিস।
অনিক লুম্বা মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছেন।
আমি বললাম, কবিদের কোনো মাথার ঠিক আছে নাকি? হয়তো লিখে ফেলবে—
হে মশা
তোমার পাখার পিনপিন শব্দে
আমার চোখে আর ঘুম আসে না!
আমার কবিতা শুনে অনিক লুম্বা আবার হি হি করে হাসল। দুজনে মিলে আমরা কবিদের পাগলামি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি করলাম। আমাদের দুইজনের কারোই যে কবি হয়ে জন্ম হয় নাই সেটা চিন্তা করে দুজনেই নিজেদের ভাগ্যকে শাবাশ দিলাম। তারপর সাহিত্যিকদের নিয়ে হাসাহাসি করলাম। তারপর শিল্পী এবং গায়কদের নিয়ে হাসাহাসি করলাম। তারপর উকিল আর ব্যবসায়ীদের নিয়ে হাসাহাসি করলাম। অনিক লুম্বা বিজ্ঞানী আর আমি নিষ্কর্মা বেকার, তাই শুধু বিজ্ঞানী আর নিষ্কর্মা বেকার মানুষদের নিয়ে হাসাহাসি করলাম না। অনিক লুম্বা তখন কয়েকটা চিপসের প্যাকেট আর এক লিটারের পেপসির বোতল নিয়ে এল। দুইজনে বসে চিপস আর পেপসি খেয়ে আরো কিছুক্ষণ আড্ডা মারলাম।
আমি যখন চলে আসি তখন অনিক লুম্বা আমার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, জাফর ইকবাল, যখন ইচ্ছা চলে এস দুইজন আডডা মারব।
আমি বললাম, আসব অনিক আসব। তুমি দেখো কালকেই চলে আসব। খুব একটা উঁচু দরের রসিকতা করেছি এইরকম ভঙ্গি করে আমরা দুইজন তখন হা হা করে হাসতে শুরু করলাম।
বাসায় আসার সময় হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারলাম অনিক সুস্বার সাথে আমার নিশ্চয়ই এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। আমরা দুইজন খেয়াল না করেই একজন আরেকজনকে নাম ধরে ডাকছি, তুমি করে সম্বােধন করছি! কী আশ্চর্য ঘটনা, আমার মতো নীরস নিষ্কর্মা ভোতা টাইপের মানুষের একজন বন্ধু হয়ে গেছে? আর সেই বন্ধু হেজিপেজি কোনো মানুষ নয় রীতিমতো একজন বিজ্ঞানী?
অনিককে বলেছিলাম পরের দিনই তার বাসায় যাব কিন্তু আসলে তার বাসায় আমার যাওয়া হল দুদিন পর। সেদিন হয়তো আমার যাওয়া হত না কিন্তু অনিক দুপুরে ফোন করে বলল আমি যেন অবশ্য অবশ্যই তার বাসায় যাই, খুব জরুরি দরকার। তাই বিকেলে অন্য একটা কাজ থাকলেও সেটা ফেলে আমি অনিকের বাসায় হাজির হলাম।
অনিক ছোট ছোট টেস্টটিউবে ঝাঁজালো গন্ধের কী এক তরল পদার্থ ঢালাচালি করছিল, আমাকে দেখে মনে হল একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
বলল, তুমি এসে গেছ? চমৎকার!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? কী হয়েছে?
একজন আমার সাথে দেখা করতে আসবে—আমি একা একা তার সাথে কথা বলতে চাই না।
কেন?
সে আমার মশার গবেষণা কিনতে চায়।
মশার গবেষণা কিনতে চায়? আমি অবাক হয়ে বললাম, গবেষণা কি কোরবানির গরু-মানুষ এটা আবার কেনে কী করে? আর এই লোক খবর পেল কেমন করে যে তুমি মশা নিয়ে গবেষণা কর?
পদচারী বিজ্ঞানী কনভেনশনের কথা মনে নাই? মনে হয় সেখানে আমার মুখে শুনেছে। আমি কাউকে কাউকে বলেছিলাম।
কন্তু দিয়ে গবেষণা কিনবে?
সেটা তো জানি না। সেজন্যেই তোমাকে ডেকেছি। টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলতে পারবে না?
আমি মাথা চুলকালাম, বললাম, আসলে সেটা আমি একেবারেই পারি না।