অনেক মশা। আমি মশার চাষ করি তো।
মশার চাষ? আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, মশার আবার চাষ করা যায় নাকি?
করা যাবে না কেন? মানুষ যদি সবজির চাষ করতে পারে, মাছের চাষ করতে পারে। তা হলে মশার চাষ করতে পারবে না কেন?
আমি দুর্বলভাবে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করলাম, সবক্রি আর মাছ তো মানুষ খেতে পারে। মশা কি খেতে পারে?
ছোট মানুষ অবুঝের মতো কথা বললে বড়রা যেভাবে হাসে অনিক লম্বা অনেকটা সেভাবে হাসল, বলল, শুধু খাবার জন্যে চাষ করতে হয় কে বলেছে? গবেষণা করার জনেও চাষ করতে হয়। আপনার গলায় ইনফেকশন হলে গলা থেকে জীবাণু নিয়ে সেটা নিয়ে কালচার করে না সেটা কী? সেটা হচ্ছে জীবাণুর চাষ।
আমি তখনো ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না, জিজ্ঞেস করলাম, জীবাণুর চাষের ব্যাপারটা না হয় বুঝতে পারলাম অসুখবিসুখ হয়েছে কিনা দেখে। মশার চাষ দিয়ে কী দেখবেন?
অনিক লুম্বা মাথা নেড়ে বলল, আমাদের দেশে মশা একটা মহাসমস্যা, সেই সমসা কীভাবে মেটানো যায় সেটা নিয়ে গবেষণা করার জন্যে দরকার মশা। অনেক মশা, লক্ষ লক্ষ মশা।
আপনার কাছে লক্ষ লক্ষ মশা আছে?
আছে। শুনলেন না শব্দ? হঠাৎ করে যখন সেগুলো উড়তে থাকে তখন পাখার শব্দ শুনে মনে হয় প্লেন উড়ছে।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, দেখাবেন একটু? দেখবেন? অনিক লুম্বা দাঁড়িয়ে বলল, আসেন। ভেতরে আসেন।
আমি অনিক লুম্বার সাথে ভেতরে গেলাম। বাইরের ঘরটাই যথেষ্ট অগোছালো কিন্তু ভেতরে গিয়ে মনে হল সেখানে সাইক্লোন বা টাইফুন হয়ে গেছে। যন্ত্রপাতি যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেখানে কোনটা কী বোঝার কোনো উপায় নেই। মাঝামাঝি একটা হলঘরের মতো, সেখানে একমাথা উঁচু একটা কাচের ঘর। আট-দশ ফুট চওড়া এবং নিচে পানি। দূর থেকে মনে হচ্ছিল ভেতরে ধোয়া পাক খাচ্ছে, কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম সেগুলো ধোয়া নয়—মশা। একসাথে কেউ কোনো দিন এত মশা দেখেছে বলে মনে হয় না। কাচের ঘরের ভেতরে লক্ষ লক্ষ নয়—নিশ্চয়ই কোটি কোটি মশা! ছোট একটা মশাকে দেখে কেউ কখনো ভয় পায় না কিন্তু এই কাচের ঘরে কোটি কোটি শশা দেখে ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমি শুয়ে শুয়ে বললাম, যদি কাচের ঘর ভেঙে মশা বের হয়ে যায় তখন কী হবে?
অনিক লুম্বা মেঝে থেকে একটা বিশাল হাতুড়ি তুলে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নেন, ভাঙার চেষ্টা করেন।
আমি আঁতকে উঠে বললাম, সর্বনাশ! ভেঙে গেলে উপায় আছে? সারা ঢাকা শহর মশায় অন্ধকার হয়ে যাবে!
অনিক লুম্বা হাসল, বলল, ভাঙবে না। এটা সাধারণ কাচ না। এর নাম প্রেক্সি গ্লাস। কাচের বাবা।
তারপরেও আমি সাহস পেলাম না। তখন অনিক লুম্বা নিজেই হাতুড়ি দিয়ে এক ঘা দিল। কাচের ঘরের কিছুই হল না সত্যি কিন্তু ভেতরের মশাগুলো যা খেপে উঠল সে আর বলার মতো না, মনে হল পুরো ঘরটাই উড়িয়ে নিয়ে যাবে! কাচের ঘরের সমস্ত মশা একসাথে উড়তে শুরু করল। প্রচণ্ড শব্দ শুনে মনে হল একটা ফাইটার প্লেন কোনোভাবে ঘরে ঢুকে গেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত মশার চাষ করছেন কেমন করে?
মশার শব্দে অনিক লুম্বা কিছু শুনল না, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে আবার জিজ্ঞেস করতে হল। অনিক লুম্বাও উত্তর দিল চিৎকার করে, নিচে পানিতে মশা ডিম পাড়ে। সেখান থেকে লার্ভা বের হয়, সেখান থেকে মশা। চব্বিশ ঘণ্টা এদের খাবার দেওয়া হয়। মশা বড় হওয়ার জন্যে একেবারে সঠিক তাপমাত্রা, সঠিক হিউমিডিটির ব্যবস্থা আছে।
আমি বললাম, মশাগুলোর উচিত শাস্তি হচ্ছে।
অনিক লুম্বা অবাক হয়ে বলল, উচিত শাস্তি?
হ্যাঁ। কাচের ঘরের ভেতরে আটকা পড়ে আছে, কাউকে কামড়াতে পারছে না–এটা শাস্তি হল না?
অনিক লুম্বা হা হা করে হেসে বলল, না না। আপনি যেভাবে ভাবছেন সেভাবে মশার শাস্তি মোটেই হচ্ছে না।
তার মানে? এরা এখনো মানুষকে কামড়াচ্ছে?
একটা মশা মানুষকে কেন কামড়ায় জানেন?
এটা আবার একটা প্রশ্ন হল নাকি! আমি বললাম, অবশ্যই জানি। মশা মানুষকে কামড়ায় তাদেরকে জ্বালাতন করার জন্যে। কষ্ট দেবার জনো। অত্যাচার করার জন্যে।
উহুঁ। অনিক লুম্বা মাথা নাড়ল, বলল, মশা মানুষকে কামড়ায় বংশবৃদ্ধি করার জন্যে। মহিলা মশার ডিম পাড়ার জন্যে রক্তের দরকার সেই জন্যে তারা মানুষকে কামড়ে একটু রক্ত নিয়ে নেয়।
সত্যি?
হ্যাঁ। কাজেই যখন একটা মশা আপনাকে কামড় দেবে আপনি বুঝে নেবেন সেটা মশা নয়, সেটা হচ্ছে মশি।
মশি?
হ্যাঁ। মানে মহিলা মশা।
আমি তখনো ব্যাপারটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে আপনি বলতে চান মশা আর মশিদের মাঝে মশারা কামড়ায় না, কামড়ায় শুধু মশি?
হ্যাঁ।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমার ধারণা ছিল পুরুষ থেকে মহিলারা মিষ্টি স্বভাবের হয়। কামড়াকামড়ি যা করার সেগুলো পুরুষরাই বেশি করে!।
না না না। অনিক লুম্বা মাথা নাড়ল, এটা মোটেও কামড়াকামড়ি নয়। মহিলা মশারা যখন আপনাকে কামড় দেয় তখন সেটা তার নিজের জন্যে না। সেটা সে করে তার সন্তানদের জন্যে। মশার কামড় খুব মহৎ একটি বিষয়। সন্তানদের জন্যে মায়ের ভালবাসার বিষয়।
সর্বনাশ! আমি বললাম, ব্যাপারটা গোপন রাখা দরকার।
অনিক লুম্বা অবাক হয়ে বলল, কেন?
দেশের পাগল-ছাগল কবি-সাহিত্যিকেরা এটা জানতে পারলে উপায় আছে? কবিতা লিখে ফেলবে না মশার ওপর!
হে মশা
সন্তানের জন্যে
তোমার ভালবাসা