বাসা খুঁজে বের করে দরজায় শব্দ করতেই অনিক লুম্বা দরজা খুলে দিল। আমার কথা মনে আছে কিনা কে জানে, তাই নতুন করে পরিচয় দিতে যাচ্ছিলাম। অনিক লুম্বা তার আগেই চোখ বড় বড় করে বলল, আরে! জাফর ইকবাল সাহেব! কী সৌভাগ্য!
আমি চোখ ছোট ছোট করে অনিক লুম্বার দিকে তাকিয়ে সে ঠাট্টা করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলাম, এর আগে কেউ আমাকে দেখাটা সৌভাগ্য বলে মনে করে নি। বরং উল্টোটা হয়েছে—দেখা মাত্রই কেমন জানি মুষড়ে পড়েছে। তবে অনিক লুম্বাকে দেখে মনে হল মানুষটা আমাকে দেখে আসলেই খুশি হয়েছে। আমার হাত ধরে জোরে জোরে ঝাকাতে আঁকাতে বলল, কী আশ্চর্য! আমি ঠিক, আপনার কথাই ভাবছিলাম।
যারা আমার কাছে টাকাপয়সা পায় তারা ছাড়া অন্য কেউ আমার কথা ভাবতে পারে আমি চিন্তা করতে পারি না। অবাক হয়ে বললাম, আমার কথা ভাবছিলেন?
হ্যাঁ।
কেন?
বসে বসে চিঠিপত্র লিখছিলাম। চিঠির শেষে নিজের নামের জায়গায় কুতুব আলী মুহম্মদ ছগীর উদ্দিন নাফছি জাহাঙ্গীর না লিখে লিখছি অনিক লুম্বা! কী সহজ। কী আনন্দ। আপনার জন্যেই তো হল।
সেটা তো আপনি নিজেই করতে পারতেন!
কিন্তু করি নাই। ক্যা হয় নাই। অনিক লুম্বা আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে বলল, ভেতরে আসেন। বসেন।
আমি না হয়ে অন্য যে কোনো মানুষ হলে ভাবত ঘরে বসার জায়গা নাই। সোফার উপরে বইপ-খাতা-কলম এবং বালিশ। একটা চেয়ারের ওপর স্থূপ হয়ে থাকা কাপড়, শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি এবং আন্ডারওয়্যার। টেবিলে নানারকম যন্ত্রপাতি, প্লেটে উচ্ছিষ্ট খাবার, পেপসির বোতল। ঘরের দেওয়ালে কয়েকটা পোস্টার টেপ দিয়ে লাগানো। কয়েকটা শেলফ, শেলফে অনেক বই এবং নানারকম কাগজপত্র। ঘরের মেঝেতে জুতো, স্যান্ডেল, খালি চিপসের প্যাকেট, কলম, পেন্সিল, নাট-বল্ট এবং নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। দেওয়ালে কটকটে একটা লাইট। আমি একেবারে লিখে দিতে পারি অন্য যে কোনো মানুষ এই ঘরে এলে স্বলত, ইস! এই মানুষটা কী নোংরা, ঘরবাড়ি কী অগোছালো ছি! কিন্তু আমার একবারও সেটা মনে হল না—আমার মনে হল আমি যেন একেবারে নিজের ঘরে এসে ঢুকেছি। ঘরের নানা জায়গায় এই যন্ত্রপাতিগুলো ছুড়ানো-ছিটানো না থাকলে এটা একেবারে আমার ঘর হতে পারত। সোফার কম্বল বালিশ একটু সরিয়ে আমি সাবধানে বসে পড়লাম, লক্ষ রাখলাম কোনো কাগজপত্র যেন এতটুকু নড়চড় না হয়। যারা খুব গোছানো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষ তাদের ধারণা অগোছালো মানুষের সবকিছু এলোমেলো, কিন্তু এটা সত্যি না। আমি একেবারে লিখে দিতে পারি এই ঘরের ছড়ানো-ছিটানো কাগজগুলো কোনটা কী সেটা অনিক লুম্বা জানে, আমি যদি একটু উনিশ-বিশ করে দেই তাহলে সে আর কোনো দিন খুঁজে পাবে না। আমরা যারা অগোছালো আর নোংরা মানুষ সবকিছুতেই আমাদের একটা সিস্টেম আছে, সাধারণ মানুষ সেটা জানে না।
অনিক লুম্বা জিজ্ঞেস করল, কী খাবেন? চা, কফি?
আমি মাথা নাড়লাম, না, কোনোটাই খাব না।
অনিক লুম্বা তখন হা হা করে হাসতে লাগল। আমি বললাম, কী হল, হাসছেন কেন?
হাসছি চিন্তা করে যদি আপনি বলতেন যে চা না হলে কফি খাবেন, তা হলে আমি কী করতাম? আমার বাসায় চা আর কফি কোনোটাই নাই!।
মানুষটাকে যতই দেখছি ততই আমার পছন্দ হয়ে যাচ্ছে। আমি সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসে বললাম, আমি যে হঠাৎ করে চলে এসেছি তাতে আপনার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?
আপনি না হয়ে যদি অন্য কেউ হত তা হলে অসুবিধে হত। কী নিয়ে কথা বলতাম সেটা চিন্তা করেই পেতাম না।
আমি সোজা হয়ে বসলাম, জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আমার সাথে আপনার কথা বলতে কোনো অসুবিধে হবে না?
মনে হয় হবে না।
কেন?
কারণটা খুব সহজ। অনিক লুম্বা আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার দুপায়ে দূরকম মোজা। যে মানুষ দুপায়ে দুরকম মোজা পরে কোথাও বেড়াতে চলে আসে তার সাথে আমার খাতির হওয়ার কথা!
আমি অবাক হয়ে বললাম কেন?
এই যে এই জন্যে বলে সে তার প্যান্টটা ওপরে তুলল এবং আমি হতবাক হয়ে দেখলাম তার দুই পায়ে দুই রকম মোজা। ডান পায়ে লাল রঙের বাম পায়ে হলুদ চেক চেক। অনিক লুম্বা বলল, আমি অনেক মানুষের সাথে কথা বলেছি, কাউকে বোঝাতে পারি নাই যে দুপায়ে এক রকম মোজা পরার পিছনে কোনো যুক্তি নেই। আপনি একমাত্র মানুষ যে নিজে থেকে আমার যুক্তি বিশ্বাস করেন।
আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, শুধু মোজা নয়, আপনার সাথে আমার আরো মিল আছে।
অনিক লুম্বা অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কী রকম মিল?
আমার বাসা ঠিক একই রকম। সোফাতে বালিশ-কম্বল। চেয়ারে কাপড়-জামা। ফ্লোরে সব দরকারি কাগজপত্র।
কী আশ্চর্য! অনিক লুম্বা হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, আচ্ছা একটা জিনিস বলেন দেখি?
কী জিনিস?
মানুষ যখন গল্পগুজব করার সময় জোকস বলে আপনি সেগুলো ধরতে পারেন?
বেশিরভাগ সময় ধরতে পারি না।
অনিক লুম্বা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছেন আমাদের দুজনের মাঝে অনেক মিল।
তার কী কী খেতে ভালো লাগে সেটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন ঘরের ভেতর থেকে হঠাৎ গুঞ্জনের মতো শব্দ হল। শব্দটা হঠাৎ বাড়তে বাড়তে প্রায় প্লেনের ইঞ্জিনের মতো বিকট শব্দ করতে থাকে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কিসের শব্দ?
অনিক লুম্বা মাথা নেড়ে বলল, মশা।
মশী! আমি অবাক হয়ে বললাম, এটা আবার কী রকম মশা? একেবারে প্লেনের ইঞ্জিনের মতো শব্দ!