আমি একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু ভদ্রলোক তো আপত্তি করলেন না। ব্যাজটা নিয়ে বেশ খুশি খুশি হয়ে চলে গেলেন।
হাসিখুশি মহিলা সরু চোখ করে বললেন, ভদ্রলোক আপনাকে দেখেই বুঝেছেন অপিত্তি করে কোনো লাভ নেই। যেই মানুষ বলার আগেই নাম লিখে ফেলে তার সাথে কথা বাড়িয়ে বিপদে পড়বে নাকি?
আমি থতমত খেয়ে গলা বাড়িয়ে অনিক লুধাকে খুঁজলাম কিন্তু সেই মানুষটা তখন ভিড়ের মাঝে পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।
সামনে পদচারী বিজ্ঞানীদের অনেক লম্বা লাইন হয়ে গেছে, তাই আবার কাজ শুরু করতে হল। কিন্তু একটা মানুষের বাজে এরকম একটা বিদঘুটে নাম লিখে দিয়েছি বলে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। আমার পাশে বসে থাকা হাসিখুশি মহিলা সবার সাথে হাসিমুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও একটু পরে পরে আমার দিকে তাকিয়ে বিষদৃষ্টিতে মুখ ঝামটা দিতে লাগলেন। আমি কী করব বুঝতে না পেরে একটু পরে পরে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে কাজ করে যেতে লাগলাম।
রেজিষ্ট্রেশন কাজ শেষ হবার পর আমি বিজ্ঞানী অনিক লুম্বাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। হলঘরে ছোট ছোট অনেক টেবিল বসানো হয়েছে, সেই টেবিলগুলোর ওপর পদচারী বিজ্ঞানীদের নানারকম গবেষণা সাজানো। গোবর নিয়ে নিশ্চয়ই অনেকগুলো আবিষ্কার রয়েছে কারণ হলঘরের ভেতরে কেমন জানি গোবর গোবর গন্ধ। টেবিলে নানারকম গাছপালা, গাছের চারা এবং অর্কিড় সাজানো। অদ্ভুত ধরনের কিছু ছেনি এবং হাতুড়িও আছে। বোতলে বিচিত্র ধরনের মাছ, কিছু হাঁড়ি-পাতিল এবং চুলাও টেবিলে সাজানো রয়েছে। অল্প কিছু টেবিলে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি এবং ইলেকট্রনিক সার্কিট সাজানো। এরকম একটা টেবিলে গিয়ে আমি অনিক লুম্বাকে পেয়ে গেলাম। তাকে ঘিরে ছোটখাটো একটা ভিড় এবং সে খুব উৎসাহ নিয়ে জটিল একটা যন্ত্র কীভাবে কা করে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। বোঝানো শেষ হলেও কয়েকজন মানুষ তাকে ঘিরে পঁড়িয়ে রইল, একজন একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, ভাই আপনি কোন দেশী?
কেন? বাংলাদেশী।
তা হলে আপনার নামটা এরকম কেন?
কী রকম?
এই যে অনিক লুম্বা। অনিক ঠিক আছে। কিন্তু লুম্বা আবার কী রকম নাম?
অনিক লুম্বা দাঁত বের করে হেসে বলল, লুম্বা একেবারে ফার্স্ট ক্লাস নাম। আরেকটু হলে এটা লুমুম্বা হয়ে যেত। প্যাট্রিস লুমুম্বার নাম শুনেন নাই? মানুষটি কী বলবে বুঝতে না পেরে একটু ঘেঁতো হাসি হেসে চলে গেল। যখন ভিড় একটু পাতলা হয়েছে তখন আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, এই যে ভাই। দেখেন, আমি খুবই দুঃখিত।
কেন? আপনি কেন দুঃখিত?
আমি রেজিস্ট্রেশনে ছিলাম। আপনার নাম কী সেটা না শুনেই ভুল করে অনিক লুম্বা লিখে দিয়েছি!
মানুষটা এবারে আমাকে চিনতে পারল এবং সাথে সাথে হা হা করে হাসতে শুরু করল। আমার লজ্জায় একেবারে মাটির সাথে মিশে যাবার অবস্থা হল, কোনোমতে বললাম, আমাকে লজ্জা দেবেন না, প্লিজ। আপনার কাজটা দেন আমি ঠিক করে দিই।
মানুষটা গোঁফ নাচিয়ে বলল, কেন? অনিক লুম্বা নামটা আপনার পছন্দ হচ্ছে না?
আমি বললাম, আসলে তা এটা পছন্দ-অপছন্দে ব্যাপার না। এটা শুদ্ধ-অশুদ্ধর বাপার। আপনার নামটা না শুনেই আজগুবি কী একটা লিখে দিলাম। ছি-ছি, কী লজ্জা!
কে বলেছে আজগুবি নাম? মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, অনিক লুম্বা খুব সুন্দর নাম। এর মাঝে কেমন জানি বিপ্লবী বিপ্লবী ভাব আছে।
আমি দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বললাম, কেন আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?
মানুষটা চোখ-মুখ গম্ভীর করে বলল, আমি মোটেও ঠাট্টা করছি না। এই নামটা আসলেই আমার পছন্দ হয়েছে। আমি এটাই রাখব।
এটাই রাখবেন?
হ্যাঁ! কনভেনশন শেষ হবার পরও আমার এই নাম থাকবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, আর আপনার আসল নাম? সার্টিফিকেটের নাম?
সার্টিফিকেটের নাম থাকুক সার্টিফিকেটে। মানুষটা মুখ শক্ত করে বলল, আমি সার্টিফিকেটের খেতা পুড়ি।
আমি বললাম, কিন্তু—
এর মাঝে কোনো কিন্তু-কিন্তু নাই। মানুষটি তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমার যখন জন্ম হয় তখন আমার দাদা আমার নাম রাখলেন কুতব আলী। আমার নানা আমার জনের খবর পেয়ে টেলিগ্রাম করে আমার নাম পাঠালেন মুহম্মদ ছগীর উদ্দিন। আমার মায়ের আবার পছন্দ মডার্ন টাইপের নাম, তাই মা নাম রাখলেন নাফছি জাহাঙ্গীর। আমার বাবা ছিলেন খুব সহজ-সরল ভালোমানুষ টাইপের। ভাবলেন কার নামটা রেখে অন্যের মনে কষ্ট দেবেন? তাই কারো মনে কষ্ট না দিয়ে আমার নাম রেখে দিলেন কুতুব আলী মুহম্মদ ছগীর উদ্দিন নাফছি জাহাঙ্গীর। সারা জীবন এই বিশাল নাম ঘাড়ে করে বয়ে বয়ে একেবারে টায়ার্ড হয়ে গেছি। আমার এই দুই কিলোমিটার লম্বা নামটা ছিল সত্যিকারের যন্ত্রণা। আজকে আপনি সব সমস্যার সমাধান করে দিলেন। এখন থেকে আমি আর কুতুব আলী মুহম্মদ ছগীর উদ্দিন নাফছি জাহাঙ্গীর না।
মানুষটি নিজের বুকে একটা থাবা দিয়ে বলল, এখন থেকে আমি অনিক লুম্বা।
আমি খানিকটা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মানুষটি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম?
আমি বললাম, জাফর ইকবাল।
মানুষটি তখন তার হাত আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে খুব খুশি হয়েছি জাফর ইকবাল সাহেব।
আমি তার সাথে হাত মিলালাম এবং এইভাবে আমার বিজ্ঞানী অনিক লুম্বার সাথে পরিচয় হল।
০২. মশা
পদচারী বিজ্ঞানী কনভেনশনে অনিক লুম্বার সাথে পরিচয় হবার পর আমি একদিন তার বাসায় বেড়াতে গেলাম। কেউ যেন মনে না করে আমি খুব মিশুক মানুষ, আর কারো সাথে পরিচয় হলেই মিষ্টির বাক্স নিয়ে তার বাসায় বেড়াতে যাই। আমি কখনোই কারো বাসায় বেড়াতে যাই না, কারণ কোথাও গেলে কী নিয়ে কথা বলতে হয় আমি সেটা জানি না। আগে যখন পত্রিকা পড়তাম তখন দেশে-বিদেশে কী হচ্ছে তার হালকা মতন একটা ধারণা ছিল, পত্রিকা পড়া ছেড়ে দেবার পর এখন কোথায় কী হচ্ছে সে সম্পর্কে একেবারে কোনো ধারণা নেই। দেশের সেরা মাস্তান কি গাল কাটা বন্ধুর নাকি নাক ভাঙা জব্বর, সেটাও আমি আজকাল জানি না। কোন নায়ক ভালো মারপিট করে, কোন নায়িকা সবচেয়ে মোটা, কোন গায়কের গলা সবচেয়ে মিষ্টি, কোন কবির কবিতা ফাটাফাটি, এমনকি কোন মন্ত্রী সবচেয়ে বড় চোর সেটাও আমি জানি না। কাজেই লোকজনের সাথে বসে কথাবার্তা বলতে আমার খুব ঝামেলা হয়। কেউ হাসির কৌতুক বললেও বেশিরভাগ সময়ে সেটা বুঝতে পারি না, যদিবা বুঝতে পারি তা হলে ঠিক কোথায় হাসতে হবে সেটা ধরতে পারি না, ভুল জায়গায় হেসে ফেলি! সেজন্য আমি মানুষজন এড়িয়ে চলি, তবে অনিক লম্বার কথা আলাদা। কেন জানি মনে হচ্ছে আমার এই মানুষটার বাসায় যাওয়া দরকার। মানুষটা অন্য দশজন মানুষের মতো না।