আমি বাইরের ঘরে এসে দরজা খুলতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম, পাহাড়ের মতন একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখটা বাঘের মতন। চোখ দুটো জ্বলছে, চুল পিছনে ঝুঁটি করে বাঁধা। আমাকে কেউ বলে দেয় নি, কিন্তু দেখেই আমি বুঝতে পারলাম, এই মহিলা নিশ্চয়ই দুর্দানা বেগম। মহিলাটি বাঘিনীর মতো গর্জন করে বলল, এই বাসায় একটা ছোট বাচ্চা পাওয়া গেছে?
আমি মিনমিন করে বললাম, হ্যাঁ।
আমি বাচ্চাটাকে দেখতে এসেছি।
আমি বললাম, বা-বা-বাচ্চাটাকে দেখতে এসেছেন?
হ্যাঁ মহিলা গর্জন করে বলল, আমার নাম দুর্দান বেগম। আমি ছোট বাচ্চাদের একটা হোম চালাই।
ও আচ্ছা। আমি বললাম, ভেরি গুড ভেরি গুড—
মহিলা আবার গর্জন করল, বাচ্চা কোথায়?
আছে ভেতরে।
দেখান আমাকে।
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, বাচ্চার কী দেখতে চান?
বাচ্চাকে কীভাবে রাখা হয়েছে, কী খাচ্ছে, কীভাবে ঘুমাচ্ছে—এইসব। বাচ্চার বিপদের ঝুঁকি আছে কিনা, অযত্ব হচ্ছে কিনা—পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আছে কিনা—
দুর্দানা বেগমের লিস্ট অনেক বড়, মাত্র বলতে শুরু করেছিল কিন্তু হঠাৎ করে থেমে গেল, কারণ ঠিক তখন বাসার সামনে একটা পুলিশের গাড়ি থেমেছে, আর সেই গাড়ি থেকে বিশাল একজন পুলিশ অফিসার নেমে এল, একটু কাছে এলেই আমি চিনতে পারলাম, গনি সাহেব, আজ সকালে এই মানুষ আমাকে হাজতে পুরে রেখেছিল।
দরজার সামনে আমাকে দেখে গনি সাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ক্ষুধার্ত বাঘ যখন একটা নাদুসনুদুস হরিণ দেখে তার মুখে মনে হয় ঠিক এরকম হাসি ফুটে ওঠে। গনি সাহেব তার দাতগুলি বের করে বলল, আপনি এখনো আছেন?
আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, জি আছি।
নিজের চোখে দেখতে এলাম।
কী দেখতে এসেছেন?
বাচ্চাটা আসলেই আছে কিনা। থাকলেও কেমন আছে—আজকাল কোনো কিছুর ঠিক নাই। হয়তো ছোট বাচ্চাটার ওপর অত্যাচার।
দুর্দানা বেগমের পুলিশের কথাটা খুব মনে ধরল। বলল, ঠিক বলেছেন। ছোট বাচ্চাও যে একজন মানুষ সেটা অনেকের খেয়াল থাকে না। এক বাসায় গিয়ে দেখি বাচ্চাকে ভেজা কাঁথার মাঝে শুইয়ে রেখেছে।
গনি সাহেব বলল, ভেজা কঁাথা কী বলছেন? আমি গ্যারান্টি দিতে পারি, এই ঢাকা শহরে এমন ঘাঘু ক্রিমিনাল আছে যে পারলে বাচ্চাকে পানিতে ড়ুবিয়ে রাখবে।
দুর্দানা বেগম চোখ গোল গোল করে বলল, বলেন কী আপনি?
গনি সাহেব নাক দিয়ে শব্দ করে বলল, আমি এই লাইনের মানুষ, চোর-ডাকাত-গুণ্ডা নিয়ে আমার কারবার। দুনিয়ায় যে কত কিসিমের মানুষ আছে আপনি জানেন না। আমি
জানি।
গনি সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই বাসা কার?
আমি মিনমিন করে বললাম, আমার বন্ধুর।
তাকে ডাকেন।
আমি কিছু বলার আগেই দুইজনে প্রায় ঠেলে বাইরের ঘরে ঢুকে গেল। আমি তাদেরকে বসিয়ে প্রায় দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। বাচ্চাটা তখনো অ্যাকুরিয়ামে মহাআনন্দে সঁতরে বেড়াচ্ছে, অনিক চোখ-মুখে একটা মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে বাচ্চাটাকে দেখছে। আমাকে দেখে বলল, কী হল, পেপারটা আনতে এতক্ষণ?
আমি ফিসফিস করে বললাম, পেপার না।
তা হলে কে?
দুর্দানা বেগম আর গনি সাহেব। বাচ্চা দেখতে এসেছে। এক্ষুনি বাচ্চাকে পানি থেকে তোল। এক্ষুনি।
বাইরের ঘর থেকে দুর্দানা বেগম আবার বাঘিনীর মতো গর্জন করল, কোথায় বাড়ির মালিক?
অনিক ফিসফিস করে বলল, আমি ওদেরকে কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখছি। তুমি বাচ্চাটাকে তোল। মাস্ক খুলে একটা টাওয়েলে জড়িয়ে নিয়ে আস।
আ-আ-আমি?
তুমি নয় তো কে?
বাইরের ঘর থেকে আবার হুঙ্কার শোনা গেল, কোথায় গেল সবাই?
অনিক তাড়াতাড়ি উঠে গেল। আমি তখন বাচ্চাটাকে পানি থেকে তোলার চেষ্টা করলাম। এত ছোট একটা বাচ্চাকে যখন শুকনো জায়গায় রাখা হয় তখন সে নড়তে চড়তে পারে না, এক জায়গায় শুয়ে থাকে। কিন্তু পানিতে সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। একটা ছোট বাচ্চা সেখানে তুখোড় সাঁতারু। আমি তাকে চেষ্টা করেও ধরতে পারি না। একবার খপ করে তার পা ধরলাম সে পিছুলে বের হয়ে গেল। আরেকবার তার হাত ধরতেই ডিগবাজি দিয়ে সরে গেল। শুধু যে সরে গেল তা না, মনে হল আমার দিকে তাকিয়ে জিব বের করে একটা ভেংচি দিল। এবার দুই হাত ঢুকিয়ে তাকে ধরতে চেষ্টা করলাম, তারপরেও কেমন করে যেন পিছলে বের হয়ে গেল। অনিক কতক্ষণ দুর্দানা বেগম আর গনি সাহেবকে আটকে রাখতে পারবে কে জানে, আমি এবার তাকে ভালোভাবে ধরার চেষ্টা করলাম আর তখন ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটল। বাচ্চাটার নিশ্বাস নেবার টিউবটা আমার হাতে পেঁচিয়ে গেল, বাচ্চাটা আমার হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্যে একটা ডিগবাজি দিতেই তার মুখ থেকে মাস্কটা খুলে যায়। মাস্কটার ভেতর থেকে অক্সিজেনের বুদ্বুদ বের হতে থাকে আর সেটা ধীরে ধীরে পানিতে ভেসে উঠতে থাকে।
আমি অনেক কষ্ট করে চিৎকার চেপে রাখলাম-বিস্ফারিত চোখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছি, দেখছি ধীরে ধীরে বাচ্চাটা পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চাটাকে ধরার চেষ্টা করছি, আর কী আশ্চর্য সেই অবস্থায় আমার হাত থেকে সে পিছলে বের হয়ে গেল। বাচ্চাটার নিশ্বাস নেবার জন্যে অক্সিজেন নেই কিন্তু সেটা নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই। অ্যাকুরিয়ামের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় মাছের মতো সঁতরে যেতে যেতে দুটো ডিগবাজি দিল। তারপর হাত-পা নাচিয়ে আমার দিকে এগিয়ে জিব বের করে আমাকে ভেংচে দিল। কিন্তু নিশ্বাস নেবে কীভাবে? আমি আবার হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করলাম, বাচ্চাটা আমার হাত থেকে পিছলে বের করে মাথাটা পানির ওপর এনে নিশ্বাস নিয়ে আবার পানির নিচে ড়ুবে গেল! এই বাচ্চার মতো চালু বাচ্চা আমি আমার জন্যে কখনো দেখি নি। আগে মুখে একটা মাঙ্কু লাগানো ছিল, সেখান থেকে অক্সিজেনের নল বের হয়েছিল, এত কিছু ঝামেলা নিয়ে সার দিতে তার রীতিমতো অসুবিধে হচ্ছিল। এখন তার শরীরের সাথে কিছু লাগানো নাই, সাঁতার দিতেও ভারি সুবিধে। তাকে ধরবে এমন সাধ্যি কার আছে? পানির ভেতবে ডিগবাজি দিতে দিতে ছুটে যাচ্ছে, আর যখন নিশ্বাস নেবার দরকার হয় তখন ভুশ করে মাথা বের করে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে আবার পানিতে ঢুকে যাচ্ছে। আমি বিস্ফারিত চোখে এই বিস্ময়কর দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। পুরো ব্যাপারটি তখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।