অনিক ছুটে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, একটা ছোট বাচ্চা ঘরে থাকলে এরকম কঁাড়ের মতো চিৎকার করতে হয় না।
অনেক কষ্টে গলা না তুলে শান্ত গলায় বললাম, আমি সঁড়ের মতো চিৎকার করতে চাই না। কিন্তু তুমি যেসব কাজকর্ম করতে চাইছ সেটা শুনলে যে কোনো মানুষ সঁড়ের মতো চিৎকার করবে।
বাচ্চাটা একটু শান্ত হয়েছে। অনিক আবার তাকে আলমারিতে বন্ধ করে রাখতে রাখতে বলল, তুমি কি ভাবছ আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে কোনোরকম বিপদের কাজ করব?
একটা বাচ্চাকে পানিতে ফেলে দেওয়ার থেকে বড় বিপদের কাজ কী হতে পারে?
তুমি শান্ত হও। আমার কথা আগে শোন। একটা বাচ্চা যখন মায়ের পেটে থাকে তখন সে কোথায় থাকে?
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, এটা আবার কী রকম প্রশ্ন? মায়ের পেটে যখন থাকে তখন তো মায়ের পেটেই থাকে।
আমি সেটা বলছি না—আমি বলছি মায়ের পেটের ভেতরে কোথায় থাকে? একটা তরল পদার্থের ভেতর। সেখানে তার নিশ্বাস নিতে হয় না কারণ আমবিলিকেল কর্ড দিয়ে মায়ের শরীর থেকে অক্সিজেন পায়, পুষ্টি পায়।
অনিক জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে পারলে থামতে চায় না, তাই হাত নেড়ে বলতে লাগল, জন্ম হবার পর ফুসফুস দিয়ে নিশ্বাস নিতে হয়। অ্যামিবিলিকেল কর্ড কেটে দেওয়াহয় বলে মুখ দিয়ে খেতে হয়। মায়ের পেটের ভেতরে তরল পদার্থে তারা খুব আরামে থাকে, তাই জন্মের পরও তাদেরকে পানিতে ছেড়ে দিলে তারা মনে করবে পেটের ভেতরেই আরামে আছে–
আমি আপত্তি করে বললাম, ঠাণ্ডায় নিউমোনিয়া হয়ে যাবে।
অনিক বলল, আমি কি ঠাণ্ডা পানিতে ছাড়ব নাকি?
তা হলে কোথায় ছাড়বে?
পানির তাপমাত্রা থাকবে ঠিক মায়ের শরীরের তাপমাত্রা। কুসুম কুসুম গরম—
আর নিশ্বাস?
মুখে লাগানো থাকবে মাস্ক। সেখানে থাকবে অক্সিজেন টিউব।
কান দিয়ে যদি পানি ঢোকে?
কানে থাকবে এয়ার প্লাগ।
কিন্তু তাই বলে একটা ছোট বাচ্চাকে পানিতে ছেড়ে দেওয়া—
অনিক বলল, আমি কি বাচ্চাকে ঝপাং করে পানিতে ফেলে দেব? আস্তে করে নামাব। যদি দেখি বাচ্চাটা পছন্দ করছে আস্তে আস্তে প্রথমে পা তারপর শরীর তারপর মাথা–
কিন্তু–
এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। এই এক্সপেরিমেন্ট আমাকে আর কে করতে দেবে? তুমি দেখ এর মাঝে বাচ্চাটাকে একবারও আমি বিপদের মাঝে ফেলব না।
অনিকের ওপর আমার সেটুকু বিশ্বাস আছে, তাই আমি শেষ পর্যন্ত রাজি হলাম।
অনিক অ্যাকুরিয়ামটা পানিতে ভর্তি করে সেটার মাঝে একটু গরম পানি মিশিয়ে পানিটাকে আরামদায়ক কুসুম কুসুম গরম করে নিল। পানিতে একটা ছোট হিটার আরেকটা থার্মোমিটার বসাল। থার্মোমিটারের সাথে অনেক জটিল যন্ত্রপাতি। তাপমাত্রা কমতেই নাকি নিজে থেকে হিটার চালু হয়ে আবার আগের তাপমাত্রায় নিয়ে যাবে। অ্যাকুরিয়ামের পাশে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার। তার পাশে একটা নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার। দুটো গ্যাস মাপমতো মিশিয়ে সেখান থেকে একটা প্রাস্টিকের টিউবে করে একটা ছোট মাঙ্কে লাগিয়ে নিল। এই ছোট মাস্কটা বাচ্চার মুখে লাগাবে।
সবকিছু ঠিকঠাক করে অনিক বাচ্চাটাকে নিয়ে আসে। তার মুখে মাস্কটা লাগানোর সময় সে কয়েকবার টা টা করে আপত্তি করল কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেনে নিল। যখন দেখা গেল সে বেশ আরামেই নিশ্বাস নিচ্ছে তখন শুনিক সাবধানে বাচ্চাটার জামাকাপড় খুলে অ্যাকুরিয়ামের পানিতে নামাতে থাকে। আমি পাশেই একটা শুকনো তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, যদি বাচ্চাটা পানি পছন্দ না করে তা হলে অনিক তুলে আনবে, আমি শরীর মুছে দেব।
কিন্তু পা-টা পানিতে ডোবানো মাত্রই বাচ্চাটার চোখ খুলে গেল এবং আনন্দে হাত-পা নাড়তে লাগল। অনিক খুব ধীরে ধীরে বাচ্চাটাকে নামাতে থাকে, কুসুম কুসুম গরম পানি, বাচ্চাটার নিশ্চয়ই খুব আনন্দ হচ্ছে, সে হাত-পা নাড়তে নাড়তে ফুর্তি করতে শুরু করে দিল। অনিক আরো সাবধানে নামিয়ে প্রায় গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে দিল, তখন বাচ্চাটা একেবারে পাকা সাঁতারুর মতো সাঁতার কাটতে শুরু করে দিল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম অনিকের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে সে অ্যাকুরিয়ামের ভেতর সাঁতার কাটছে। হঠাৎ করে মাথা পানির ভেতরে ড়ুবিয়ে পানির নিচে চলে গেল, আমি ভয়ে একটা চিৎকার করে উঠছিলাম কিন্তু দেখলাম ভয়ের কিছু নেই। বাচ্চাটা নির্বিঘ্নে মাস্ক দিয়ে নিশ্বাস নিতে নিতে পানিতে ওলটপালট খেয়ে সাতার কাটছে। এরকম আশ্চর্য একটা দৃশ্য যে হতে পারে আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
অনিক আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, দেখেছ? দেখেছ তুমি?
হ্যাঁ।
ছোট বাচ্চা পানিতে কত সহজে সাঁতার কাটে দেখেছ?
সত্যিই তাই। এইটুকুন ছোট বাচ্চা পানির নিচে ঠিক মাছের মতো সাঁতার কাটতে লাগল। দুই হাত দুই পা নেড়ে অ্যাকুরিয়ামের একপাশ থেকে অন্যপাশে চলে যাচ্ছে, হঠাৎ ওপরে উঠে আসছে, হঠাৎ ডিগবাজি দিয়ে নিচে নেমে আসছে। একেবারে অবিশ্বাস্য দৃশ্য। অনিক বলল, এক্সপেরিমেন্ট কমপ্লিট। এবারে তুলে নেওয়া যাক, কী বলো?
আমি বললাম, আহা হা! বাচ্চাটা এত মজা করছে, আরো কিছুক্ষণ থাকুক না।
অনিক বলল, ঠিক আছে তা হলে থাকুক।
ঠিক এই সময় দরজায় শব্দ হল। আমি চমকে উঠে বললাম, কে?
অনিক বলল খবরের কাগজ নিয়ে এসেছে। তুমি দরজা খুলে কাগজটা রেখে দাও দেখি–আমি বাচ্চাটাকে দেখছি।