এত বয়স হয়েছে এখনো বিয়ে করেন নাই? পুলিশ অফিসার ভুরু কুঁচকে বলল, কী করেন আপনি?
ইয়ে সেরকম কিছু করি না।
তা হলে আপনার সংসার চলে কেমন করে?
আমি তখন ঘামতে শুরু করেছি। আমতা-আমতা করে বললাম, আসলে সেরকম সংসারও নাই–
পাশের টেবিলে একজন মহিলা পুলিশ বসে ছিল। সে বলল, স্যার ভেরি সাসপিশাস কেস। দেখেও সেরকম মনে হয়। চুয়ান্ন ধারায় অ্যারেস্ট দেখিয়ে লকআপে ঢুকিয়ে দেন—
আমি আঁতকে উঠে বললাম, কী বলছেন আপনি?
মহিলা পুলিশ বলল, ঠিকই বলেছি। আমরা এই লাইনে কাজ করি। একজন মানুষকে দেখলেই বুঝতে পারি সে কী জিনিস?।
পুলিশ অফিসার নতুন একটা ম্যাচকাঠি বের করে আবার দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, ঠিকই বলেছ। চুয়ান্ন ধারায় চালান করে দেই। জন্মের মতো শিক্ষা হয়ে যাবে।
একজন মানুষকে যে চাউলের বস্তার মতো চালান করা যায় আমি জানতাম না, কিন্তু কিছু বোঝার আগেই দেখলাম সত্যি সত্যি হাজতের মাঝে চালান হয়ে গেছি। ঘরঘর করে লোহার গেটটা টেনে বিশাল একটা তালা ঝুলিয়ে যখন আমাকে হাজতে আটকে ফেলল, আমার মাথায় তখন রীতিমতো আকাশ ভেঙে পড়ল।
হাজতের ভেতরে যে জিনিসটা সবচেয়ে প্রথমে লক্ষ করলাম সেটা হচ্ছে দুর্গন্ধ। দুর্গন্ধটা কোথা থেকে আসছে সেটাও দেখা যাচ্ছে। ভয়ের চোটে আমার বাথরুম পেয়ে গেছে কিন্তু হাজতের ভেতরে এই দরজাবিহীন বাথরুম দেখে সেই বাথরুমের ইচ্ছাও উবে গেল। ভেতরে গোটা দশেক মানুষ শুয়ে-বসে আছে। দুই-চারজনকে একটু চিন্তিত মনে হল, তবে বেশিরভাগই নির্বিকার। একজন ম্যাচের কাঠি দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আছে?
কিসের কথা জিজ্ঞেস করছে বুঝতে পারলাম না, বললাম, কী আছে?
সেইটাও যদি বলে দিতে হয় তা হলে হাজ্জতে আমি আর আপনি কথা বলছি কেন?
আমি বললাম, আমি মানে আসলে—
আরেকজন বলল, বাদ দে। চেহারা দেখছিস না লেব্দু, টাইপের।
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, কিসের কেইস আপনার?
আমি বললাম, কোনো কেইস না। ভুল করে–
কথা শেষ হবার আগেই হাজতে বসে থাকা সবাই হা হা করে হেসে উঠল যেন আমি খুব মজার একটা কথা বলেছি। একজন হাসি থামিয়ে বলল, আমাদের সামনে গোপন করার দরকার নাই। বলতে পারেন, কোনো ভয় নাই–
আমি বললাম, না, না, আপনারা যা ভাবছেন মোটেও তা না। একটা ছোট বাচ্চা–
কথা শেষ করার আগেই একজুন বলল, ও! ছেলেধরা!
আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম তখন আরেকজন বলল, লজ্জা করে না ছেলেধরার কাম করতে? বুকে সাহস থাকলে ডাকাতি করবেন। সাহস না থাকলে চুরি করবেন। তাই বলে ছেলেধা? ছি ছি ছি।
ষাগোছের একজন বলল, বানামু নাকি?
মাঝ বয়সের একজন বলল, এখন না। অন্ধকার হোক।
মণ্ডগোছের মানুষটা বিরস মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল কখন অন্ধকার হবে আর কখন আমাকে বানাবে সে জন্যে অপেক্ষা করার তার ধৈর্য নাই। আমার মনে হল আমি ডাক ছেড়ে কাঁদি।
আমার অবিশ্যি ডাক ছেড়ে কাদতে হল না, ঘণ্টাখানেকের মাঝে সুব্রত এসে আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে গেল। যে পুলিশ অফিসার আমাকে চালান দিয়েছিল সে-ই তালা খুলে আমাকে বের করে আনল। সুব্রত তার হাত ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, খ্যাংক ইউ গনি সাহেব। থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
গনি সাহেব বললেন, আমাকে থ্যাংকস দেওয়ার কিছু নাই। আইনের মানুষ, আইন যেটা বলে আমরা সেটাই করি। তার বাইরে যাবার আমাদের কোনো ক্ষমতা নাই।
থানা থেকে বের হয়েই সুব্রত আমাকে গালাগাল শুরু করল। বলল, তোর যতো গাধা আমি জন্মে দেখি নাই। জিডি করতে এসে নিজে অ্যারেস্ট হয়ে গেলি? আমার যদি আসতে আরেকটু দেরি হত, তা হলে কী হত? যদি জেলখানায় চালান করে দিত?
আমি বললাম, তুই দেরি করে এলি কেন? তোর জন্যেই তো আমার এই বিপদ।
আমি রওনা দিয়ে ভাবলাম ছোট বাচ্চাদের একটা হোম থেকে খোঁজ নিয়ে যাই। তোর বন্ধু পুরুষ, ছোট বাচ্চার দেখাশোনা করতে পারবে না। এর জন্যে দরকার একটা হোম। একটা অনাথাশ্রম।
আছে এরকম জায়গা?
থাকবে না কেন? এই যে ঠিকানা নিয়ে এসেছি। কথাও বলে এসেছি। সুব্রত আমাকে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল, যে মহিলা দায়িত্বে আছেন তার নাম দুর্দানা বেগম।
দুর্দানা বেগম? এটা কী রকম নাম?
সুব্রত বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কি নাম রেখেছি নাকি? আমাকে দোষ দিচ্ছিস কেন?
দোষ দিচ্ছি না। জানতে চাচ্ছি।
সুব্রত মুচকি হেসে বলল, তবে নামটা দুর্দানা বেগম না হয়ে দুর্দান্ত বেগম হলে মনে হয় আরো ভালো হত।
কেন?
আসলেই দুর্দান্ত মহিলা। অনাথাশ্রমটাকে চালায় একেবারে মিলিটারির মতো। পান থেকে চুন খসার উপায় নাই। কী ডিসিপ্লিন—দেখলে অবাক হয়ে যাবি।
আমি ভীতু মানুষ, নিয়মশৃঙ্খলাকে বেশ ভয় পাই, তাই দুর্দানা বেগম আর ভার অনাথাশ্রমের কথা শুনে একটু ভয়ই পেলাম। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাচ্চাদের মারধর করে নাকি?
আরে না। দুর্দানা বেগমের গলাই যথেষ্ট, মারধর করতে হয় না।
সুব্রত তার ঘড়ি দেখে বলল, তুই এখন কোথায় যাবি?
অনিক লুম্বার বাসায়। তুইও আয়, বাচ্চাটাকে দেখে যা।
নাহ। এখন সময় নাই। ঢাকা শহর নর্দমা পুনরুজ্জীবন কমিটির মিটিং আছে।
নর্দমা পুনরুজ্জীবনেরও কমিটি আছে?
না থাকলে হবে? ঢাকা শহর পানিতে তা হলে তলিয়ে যাবে। সুব্রত আমার দিকে হাত নেড়ে হঠাৎ লাফ দিয়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে গেল। বাস থেকে মাথা বের করে বলল, আজকেই দুর্দানা বেগমের সাথে যোগাযোগ করবি কিন্তু।