কী আশ্চর্য!
আসলেই আশ্চর্য। এখন কী করতে হবে বল।
পুলিশে জিডি করতে হবে।
জিডি? আমি অবাক হয়ে বললাম, সেটা আবার কী জিনিস?
জেনারেল ডায়েরি।
সেটা কেমন করে করতে হয়?
থানায় গিয়ে করতে হয়।
থানায়? আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম, থানা পুলিশ থেকে আমি সব সময় এক শ হাত দুরে থাকতে চাই।
হ্যাঁ। সুব্রত বলল, থানায় যেন্তে হবে। তবে তুই একা একা যাস না, কী বলতে কী বলে ফেলে আরো ঝামেলা পাকিয়ে ফেলবি। আমি আসছি।
সুব্রতের কথা শুনে আমি একটু ভরসা পেলাম, কিন্তু তবুও ভান করলাম আমি যেন একাই করে ফেলতে পারব। বললাম, তোর আসতে হবে না। আমি একাই বিড়ি করে ফেলব।
বিডি না গাধা, জিডি। তোর একা করতে হবে না। আমি আসছি তুইও থানায় চলে আয়।
সুব্রত টেলিফোনটা রেখে দেবার পর আমি আবার অনিকের দিকে তাকালাম। সে হাতে একটা ছোট টর্চলাইট নিয়ে ছোট বাচ্চাটার সামনে লাফালাফি করছে। আমি বললাম, অনিক, আমি থানায় জিডি করিয়ে আসি।
খাও। বলে সে আবার আগের মতো ছোট ছোট লাফ দিতে লাগল। আমি আগেও দেখেছি অনিক একটা টিকটিকির দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকে। আর এটা তো টিকটিকি না—এটা একটা মানুষের বাচ্চা।
আমি থানার সামনে গিয়ে সুব্রতের খোজে ইতিউতি তাকাতে লাগলাম। তার এখনো দেখা নেই, তাকে ছাড়া একা একা আমার ভেতরে ঢোকার কোনো ইচ্ছা নেই কিন্তু থানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটা আমার দিকে কটমট করে তাকাতে লাগল। পুলিশ হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেই আমি নার্ভাস হয়ে যাই আর যখন কটমট করে তাকায়, তখন তো কথাই নেই, আমার রীতিমতো বাথরুম পেয়ে যায়। আমি থানার সামনে থেকে সরে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই পুলিশ বাজখাই গলায় হাঁক দিল, এই যে, এই যে মোটা ভাই।
তুলনামূলকভাবে আমার স্বাস্থ্য একটু ভালো কিন্তু এর আগে আমাকে কেউ মোটা ভাই ডাকে নাই। আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, আমাকে ডেকেছেন?
আর কাকে ডাকব? এদিকে শুনেন।
আমি কাছে এগিয়ে এলাম। পুলিশটা কয়েকবার আমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখল, দেখে বলল, আমি অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ করছি আপনি কেমন সন্দেহজনকভাবে থানার সামনে ইটাহাটি করছেন। ব্যাপারটা কী?
না মানে ইয়ে ইয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল, হাত ঘামতে লাগল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল।
পুলিশটা আবার ধমক দিয়ে উঠল, কী হল, প্রশ্নের উত্তর দেন না কেন?
আমি ঢোক গিলে বললাম, আমি ইডি না বিছি কী যেন বলে সেটা করাতে এসেছি।
ইভি? বিডি? সেটা আবার কী?
পুলিশের হম্বিতম্বি শুনে আমাদের ঘিরে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে উঠেছে। তার ভেতর থেকে একজন বলল, জিডি হবে মনে হয়।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, হ্যাঁ, হা জিডি। জিডি করাতে এসেছি।
পুলিশটা চোখ পাকিয়ে বলল, জিডিকে আপনি ইডি বিডি বলছেন কেন? পুলিশকে নিয়ে টিটকারি মারেন?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না-না, আমি মোটেও টিটকারি মারতে চাই নাই। শব্দটা ভুলে গিয়েছিলাম।
একটা জিনিস যদি ভুলে যান, তা হলে সেটা করাবেন কেমন করে?
প্রশ্নটার কী উত্তর দেব বুঝতে পারছিলাম না বলে চুপ করে থাকলাম। পুলিশটা ধমক দিয়ে বলল, আর জিডি করাতে হলে বাইরে ঘোরাঘুরি করছেন কেন? ভেতরে যান।
কাজেই সুব্রতকে ছাড়াই আমাকে ভেতরে ঢুকতে হল। কিছুক্ষণের মাঝেই আমাকে আমার থেকে মোটা একজন পুলিশ অফিসারের সামনে নিয়ে গেল। সে একটা ম্যাচকাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, কী ব্যাপার?
আমি বললাম, ইয়ে, একটা জিডি করাতে এসেছি।
কী নিয়ে জিডি?
একটা বাচ্চা পাওয়া গেছে।
পাওয়া গেছে না হারিয়ে গেছে?
পাওয়া গেছে।
পাওয়া গেলে আবার জিডি করাতে হয় নাকি? বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করেন বাড়ি কোথায়, সেখানে নিয়ে যান। সব কাজ কি পুলিশ করবে নাকি? পাবলিকের একটা দায়িত্ব আছে? কয়দিন পরে মনে হচ্ছে বৃষ্টি হলেও আপনারা জিডি করাতে চলে আসবেন। আপনি জানেন জিডি কস্রাতে কত সময় লাগে? কত ঝামেলা হয়? আপনাদের কোনো কাজকর্ম নাই?
পুলিশ অফিসারটা টানা কথা বলে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত যখন থামল তখন বললাম, বাচ্চাটা খুব ছোট।
কতটুকু ছোট?
আমি হাত দিয়ে বাচ্চাটার সাইজ দেখালাম। পুলিশ অফিসার চোখ কপালে তুলে বলল, কিসের বাচ্চা? মানুষের না ইন্দুরের?
জি মানুষের।
মানুষের বাচ্চা এত ছোট হয় কেমন করে? আর অত ছোট বাচ্চাটা এসেছে কেমন করে?
সেটা তো জানি না। কেউ একজন রেখে গেছে মনে হয়।
কেন রেখে গেছে?
সেটা তো জানি না।
কখন রেখে গেছে?
সেটাও তো জানি না।
বাচ্চা ছেলে না মেয়ে?
আমি মাথা চুলকে বললাম, সেটাও জানি না।
পুলিশ অফিসার দাঁত কিড়মিড় করে বলল, আপনি যদি কিছুই না জানেন, তা হলে এখানে এসেছেন কেন? আমি কি আপনার সন্ধী নাকি দুলাভাই যে আমার সাথে মশকরা করতে আসবেন? বাসাটা কোথায়?
আমি অনিকের বাসার নম্বরটা জানতাম, কিন্তু পুলিশের ধমক খেয়ে সেটাও ভুলে গেলাম, মাথা চুলকে বললাম, ইয়ে, মানে ইয়ে–
পুলিশ অফিসার একটা বাজখাই ধমক দিয়ে বলল, আপনারা কি ভাবেন আমাদের কোনো কাজকর্ম নাই? আপনাদের সাথে খোশগল্প করার জন্যে বসে আছি আপনাদের কোনো কাজকর্ম না থাকলে এইখানে চলে জাসবেন। কোনো একটা বিষয়ে জিডি করার জন্যে? শহরে মশা থাকলে জিডি করাবেন? আকাশে মেঘ থাকলে জিডি করাবেন? বউ ধমক দিলে জিডি করাবেন?
কিছু একটা বলতে হয়, তাই মিনমিন করে বললাম, ইয়ে বিয়ে করি নি এখনো, বউ ধমক দেবার চান্স নাই