এরকম নানা ধরনের অভিজ্ঞতার কারণে আমি আজকাল মোটেও অন্যের জন্যে কাজ করতে চাই না। নিজের জন্যে কাজ করে নিজেকে বিপদে ফেলে দিলে কেউ ভার খবর পায় না। কিন্তু অনোর জন্যে কাজ করে তাকে মহাগাড়ার মাঝে ফেলে দিলে তারা তো আমাকে ছেড়ে দেবে না। সুব্রতের সাথে সেটা নিয়ে কথা বলে কোনো লাভ নেই, সে আশায় আৱেকটা বিশাল লেকচার শুরু করে দেবে। আমি কিছু না বলে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ বসে রইলাম।
ওসমানী মিলনায়তনে এসে দেখি হুলস্থূল ব্যাপার। হাজার হাজার মানুষ গিজগিজ করছে। হলের ভেতরে সারি সারি টেবিল, সেই টেবিলে নানা রকম বিচিত্র জিনিস সাজানো। পচা গোবর থেকে শুরু করে জটিল ইলেকট্রনিক যন্ত্র, কী নেই সেখানে! হলে পৌঁছেই সুব্রত আমাকে ফেলে রেখে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। আমি একা একা কী করব বুঝতে না পেরে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করতে লাগলাম। সুব্রত একটু চোখের আড়াল হলে সটকে পড়ার একটা চিন্তা যে মাথায় খেলে নি তা নয়, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে সুব্রত এক বান্ডিল কাগজ নিয়ে হঠাৎ আমার কাছে দৌড়ে এল। আমার দিকে তাকিয়ে মুখ খিচিয়ে বলল, তুই লাট সাহেবের মতো এখানে দাঁড়িয়ে আছিল, মানে?
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, কী করব আমি?
কী করবি সেটা আমাকে বলে দিতে হবে? দেখছিস না কত কাজ? এই পাশে রেজিস্ট্রেশন, এই পাশে এক্সিবিট সাজানো, ওই দিকে পাবলিক ম্যানেজমেন্ট, ডান দিকে সেমিনার রুম, মাঝখানে ইনফরমেশন ডেস্ক, সব জায়গায় ভলান্টিয়ার দরকার। কোনো এক জায়গায় লেগে যা।
আমি আমতা-আমতা করে বললাম, আ-আমি লাগতে পারব না। আমাকে কোথাও লাগিয়ে দে, কী করতে হবে বলে দে।
সুব্রত বিরক্ত হয়ে বলল, তোকে দিয়ে দুনিয়ার কোনো কাজ হয় না। আয় আমার সাথে।
আমি সুব্রতের পিছু পিছু গেলাম, সে রেজিস্ট্রেশন এলাকার একটা চেয়ারে আমাকে বসিয়ে দিয়ে বলল, নে, পদচারী বিজ্ঞানীদের রেজিস্ট্রেশনে সাহায্য কর।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, সেটা কীভাবে করতে হয়?
সুব্রত ধমক দিয়ে বলল, সবকিছু বলে দিতে হবে নাকি? আশপাশে যারা আছে তাদের কাছ থেকে বুঝে নে।
সুব্রত তার কাগজের বান্ডিল নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গি করে হাঁটতে হাঁটতে কেথায় জানি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি আমার দুই পাশে তাকালাম, বাম দিকে বসেছে হাসিখুশি একজন মহিলা। ডান দিকে গোমড়ামুখো একজন মানুষ। কী করতে হবে সেটা হাসিখুশি মহিলাকে জিজ্ঞেস করতেই আমার দিকে চোখ পাকিয়ে একটা ধমক দিয়ে বসলেন। তখন গোমড়ামুখো মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলাম। মানুষটা গোমড়ামুখেই কী করতে হবে বুঝিয়ে দিল। কাজটা খুব কঠিন নয়, টাকা জমা দেওয়ার রসিদ নিয়ে পদারী বিজ্ঞানীরা আসবেন, রেজিস্টার খাতায় তাদের নাম লিখতে হবে, তারপর ব্যাজে তাদের নাম লিখে ব্যাজটা তাদের হাতে ধরিয়ে দিতে হবে। পানির মতো সোজা কাজ।
একজন একজন করে বিজ্ঞানীরা আসতে থাকে, আমি রেজিস্টার খাতায় তাদের নাম তুলে, বাজে নাম লিখে তাদের হাতে ধরিয়ে দেই, তারা সেই ব্যাজ বুকে লাগিয়ে চলে যেতে থাকে। বানানের জ্ঞান আমার খুব ভালো না, যার নাম গোলাম আলী তাকে লিখলাম গুলাম আলী, যার নাম রইস উদ্দিন তাকে লিখলাম রাইচ উদ্দিন, যার নাম খোদেজা বেগম তাকে লিখলাম কুদিজা বেগম—কিন্তু পদচারী বিজ্ঞানীরা সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। মনে হয় বেশিরভাগই লেখাপড়া জানে না, আর যারা জানে তারা নামের বানানের মতো ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায় না।
কাজ করতে করতে আমার ভেতরে মোটামুটি একটা আত্মবিশ্বাস এসে গেছে, এরকম সময় লম্বা এবং হালকা-পাতলা একজন মানুষ টাকার রসিদ নিয়ে আমার সামনে রেজিষ্ট্রেশন করতে দাঁড়াল। আমি রসিদটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নাম?
মানুষটার নাকের নিচে বড় বড় গোঁফ, চুল এলোমেলো এবং মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দুই হাতে সেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে মানুষটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম?
মানুষটা এবারে একটা নিশ্বাস ফেলে কেমন যেন কাচুমাচু হয়ে বলল, আসলে বলছিলাম কী, আমার নাম অনিক লুম্বা।
আমি একটু অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকালাম। অনিক লুম্বা আবার কী রকম নাম? মানুষটাকে দেখে তো বাঙালিই মনে হয়, কথাও বলল বাংলায়। তা হলে এরকম অদ্ভুত নাম কেন? অনিক হতে পারে। কিন্তু লুম্বা? সেটা কী রকম নাম? আমি অবিশ্যি মানুষটাকে তার নাম নিয়ে ঘাটালাম না, অন্যের নাম নিয়ে আমি তো আর খ্যাচম্যাচ করতে পারি না। নামটা রেজিস্টার খাতায় তুলে ঝটপট ব্যাজে নাম লিখে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। বুঝতে পারলাম না ঠিক কী কারণে মানুষটা ব্যাজটা হাতে নিয়ে কেমন যেন হতচকিতের মতো আমার দিকে তাকাল। মনে হল কিছু একটা বলবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু বলল না। কেমন যেন মুচকি হাসল তারপর ব্যাজটা বুকে লাগিয়ে হেঁটে হেঁটে ভিড়ের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমার বাম পাশে বসে থাকা হাসিখুশি মহিলা আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন, কী নাম লিখেছেন?
আমি বললাম, অনিক লুম্বা।
এরকম বিদঘুটে একটা জিনিস কেন লিখলেন?
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, যে নাম বলেছে সে নাম লিখব না?
হাসিখুশি মহিলা রাগ-রাগ মুখে বললেন, ভদ্রলোক মোটেও তার নাম অনিক লুম্বা বলে নাই।
তা হলে কী বলেছে?
আপনি তাকে নাম বলার সুযোগ পর্যন্ত দেন নাই। তার নামটা একটু লম্বা। তাই আপনাকে বলেছেন, আমার নাম অনেক লম্বা আর সাথে সাথে আপনি লিখে ফেললেন অনিক লুম্বা। অনিক লুম্বা কখনো কারো নাম হয়? শুনেছেন কখনো?