আমি আমতা আমতা করে বললাম, কিসের জন্যে রেডি?
রাত্রে যে বললাম?
কী বললি?
ওসমানী মিলনায়তনে। সকাল নটায়। মনে নাই?
ঘুমের মাঝে কথা বললে আমার কিছু মনে থাকে না।
সুব্রত অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বলল, কোনো দায়িত্বজ্ঞান নাই, কাণ্ডজ্ঞান নাই, এই জন্যে তোদেরকে দিয়ে কিছু হয় না। ওঠ! এখনি ওঠ। যেতে হবে।
আমি দুর্বলভাবে কুললাম, মাত্র নাস্তা করতে বসেছিলাম। তুইও আয়। কিছু একটা খা।
সব সময় শুধু তোর খাই খাই অভ্যাস। টেবিলে আমার ডাবল ডিমের পোছ দেখে বিরক্ত হয়ে বলল, খাসির মতো মোটা হয়েছিস আর এখনো ডিম খেয়ে যাচ্ছিস? জানিস না ডিমে কোলেস্টেরল থাকে? আর খেতে হবে না। ওঠ। তোর শরীরে যে মেদ আর চর্বি আছে এক মাস না খেলেও কিছু হবে না।
কাজেই আমাকে তখন তখনই উঠতে হল এবং সুব্রতের সাথে বের হতে হল। যেতে যেতে সুব্রত বলল যে সে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ওসমানী মিলনায়তনে পদচারী বিজ্ঞানী সম্মেলনে। পদচারী বিজ্ঞানী কী ব্যাপার সেটা জিজ্ঞেস করব কিনা সেটা নিয়ে একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেই ফেললাম। সুব্রত তখন ধমক দিয়ে বলল, তুই কোন দুনিয়ায় থাকিস?
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কেন কী হয়েছে?
পত্রিকায় দেখিস নি, সারা দুনিয়ায় পদচারী বিজ্ঞানীদের নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে? বিজ্ঞান এখন আর শুধু ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় ল্যাবরেটরিতে থাকবে না। বিজ্ঞান এখন সাধারণ মানুষের কাছে ঘুড়িয়ে যাবে। গরিব-দুঃখী মানুষও এখন বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করবে। চাষী-মজুর গবেষণা করবে। স্কুলের ছাত্র গবেষণা করবে। ঘরের বউ গবেষণা করবে। এর নাম দেওয়া হয়েছে বেয়ারফুট সায়েন্টিস্টস মুভমেন্ট। আমরা বাল্লা করেছি পদচারী বিজ্ঞানী আন্দোলন। গত সপ্তাহে প্রথম আলোতে বিশাল ফিচার বের হয়েছে, পড়িল নি?
পত্রিকায় যেসব খবর বের হয় সেগুলো দেখলেই মন-মেজাজ খারাপ হয়ে যায় বলে আমি যে বহুদিন হল খবরের কাগজ পড়াই ছেড়ে দিয়েছি সেটা বলে আর নতুন করে সুব্রতের গালমন্দ খেলাম না। বললাম, নাহ! খেয়াল করি নি।
তুই কোন জিনিসটা খেয়াল করিস? সুব্রত রেগেমেগে বলল, তুই যে দুই পায়ে দুই রঙের মোজ্জা পরে আছিস সেটা খেয়াল করেছিস?
মানুষকে কেন দুই পায়ে এক রঙের মোজা পরতে হবে সেটা আমি কখনোই বুঝতে পারি নি। দুই পায়ে এক রকম মোজা পরতে হবে আমি সেটা মানতেও রাজি না। তাই মোজা পরার সময় হাতের কাছে যেটা পাই সেটাই পরে ফেলি। কিন্তু সুব্রতের কাছে সেটা স্বীকার করলাম না। পাগুলো সরিয়ে নিতে নিতে অবাক হবার ভান করে বললাম, আরে তাই তো! এক পায়ে বেগুনি অন্য পায়ে হলুদ! কী আশ্চর্য! নিশ্চয়ই তাড়াহুড়া করে পরে ফেলেছি।
অসম্ভব। সুব্রত বলল, তুই নিশ্চয়ই কালার ব্লাইন্ড। কোনো সুস্থ মানুষ দুই পায়ে এরকম কাটকাটে রঙের দুটো মোজা পরতে পারে না। ভুল করেও পরতে পারে না।
আমি আলাপটা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্যে বললাম, তা, তুই পদচারী বিজ্ঞানী নিয়ে কী যেন বলছিলি?।
হ্যাঁ, এরা হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের বিজ্ঞানী। এরা কেউই ইউনিভার্সিটির প্রফেসর না। এরা কেউ পিএইচ-ডি না, এরা কেউ বড় বড় ল্যাবরেটরিতে কাজ করে না। এদের কেউ থাকে গ্রামে, কেউ শহরে। কেউ পুরুষ, কেউ মহিলা। কেউ ছোট, কেউ বড়। কেউ চাষী, কেউ মজুর। এরা নিজেদের মতো বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে। এদের আবিষ্কার হচ্ছে জীবনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে আবিষ্কার, প্রয়োজনের আবিষ্কার…
সুব্রত কথা বলতে পছন্দ করে, একবার লেকচার দিতে শুরু করলে আর থামতে পারে, একেবারে টানা কথা বলে যেতে লাগল। একবার নিশ্বাস নেবার জন্যে একটু দম নিতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আমি সেখানে গিয়ে কী করব?
সুব্রত অবাক হয়ে বলল, কী করবি মানে? সাহায্য করবি।
সাহায্য করব? আমিঃ এবারে আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি বিজ্ঞানের বও জানি না।
তোকে বিজ্ঞানের কাজ করতে হবে কে বলেছে? তুই ভলান্টিয়ারের কাজ করবি? কনভেনশনটা যেন ঠিকমতো হয় সেই কাজে সাহায্য করবি।
আমি ঢোক গিলে চোখ কপালে তুলে বললাম, ভলান্টিয়ারের কাজ করব? আমি?
কেন, অসুবিধে কী আছে? সুব্রত চোখ পাকিয়ে বলল, সব সময় স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কাজ করবি? অন্যের জন্যে কিছু করবি না?
সুব্রতের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই বলে আমি আর কথা বাড়ালাম না, চুপ করে রইলাম।
তবে আমি যে শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের জন্যে কাজ করি অন্যের জন্যে কিছু করি না, সেটা সত্যি না। আমার বড় বোনের ছোট মেয়ের বিয়ের সময় আমি গেস্টদের খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলাম। খাবার পরিবেশন করার সময় টগবগে গম খাসির বেজালার বাটিটা একজন মেজর জেনারেলের কোলে পড়ে গেল। সাথে সাথে সেই মেজর জেনারেলের সে কী গগনবিদারী চিৎকার! ভাগ্যিস অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। তা না হলে আমার অবস্থা কী হত কে জানে! আরেকবার পাড়ার ছেলেপিলের রবীন্দ্রজয়ন্তী করছে, আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে স্টেজ পরদা টানার জন্য। প্রধান অতিথি বক্তৃতা শেষ করেছে, আমার তখন প্রদা টানার কথা, আস্তে আস্তে পরদা টানছি, হঠাৎ করে পরদা কোথায় জানি আটকে গেল। পরদা খোলার জন্যে যেই একটা হ্যাচকা টান দিয়েছি সাথে সাথে বাশসহ পরদা হুঁড়মুড় করে প্রধান অতিথির ঘাড়ে! চিৎকার হইচই চেঁচামেচি সব মিলিয়ে এক হুলস্থূল কাণ্ড। এইসব কারণে আমি আসলে অন্যকে সাহায্য করতে যাই না। তারপরেও মাঝে মাঝে সাহা না করে পারি না। একদিন শাহবাগের কাছে হেঁটে যাচ্ছি, দেখি রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধ মহিলা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, অসংখ্য বাস-ট্রাক-গাড়ির ভেতর রাস্তা পার হবার সাহস পাচ্ছেন না। আমি তাকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলাম। রাস্তা পার করার সময় দুর্বলভাবে কী একটা বলার চেষ্টা করলেন আমি ঠিক শুনতে পাই নি। কিন্তু রাস্তার অন্য পাশে এসে ভদ্রমহিলার সে কী চিৎকার। বৃদ্ধ মহিলা নাকি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তার ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, মোটেও রাস্তা পার হবার চেষ্টা করছিলেন না!