লু গলা উচিয়ে বলল, তোমরা বক্তৃতা থামিয়ে আমার সাথে একটু হাত লাগাবে?
রু-টেক এগিয়ে এসে বলল, আমি বুঝি না, তুমি সিডিসির উপর ভার না দিয়ে নিজে নিজে এসব জিনিস করতে চাও কেন? মহাকাশযানকে অরবিটে আনা কিরকম ঝামেলার কাজ, তুমি জান?
মোটেই কোনো ঝামেলার কাজ না, কম্পিউটার করতে পারে বলেই ছোট-বড় সব কাজ কম্পিউটার দিয়ে করাতে হবে? মাঝেমধ্যে নিজে নিজে কিছু কাজ করতে হয়, তাতে স্নায়ু শক্ত হয়, মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন হয়, মাংসপেশীর ব্যায়াম হয়, মন প্রফুল্ল হয়—
থাক থাক, আর বলতে হবে না, কিম জিবান এগিয়ে এসে বলল, সত্যিকার কাজকর্ম নেই বলে কিছু কাজ বের করার চেষ্টা করছ। গ্রহটার যেটুকু দেখেছি, তা দেখে পরিষ্কার বলে দিতে পারি, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আর কাজ বের করতে হবে না, কোনোমতে এখন এখান থেকে জান নিয়ে পালাতে পারলে হয়।
সুশান পাংশু মুখে বলল, কেন, কী হয়েছে গ্রহটার?
নূতন কিছু নয়, কিন্তু যা দেখেছ সেটার কোনো মাথা মুণ্ডু আছে? আমার কাছে তো মনে হচ্ছে পরিষ্কার নরক।
কেন খামোকা ভয় দেখাচ্ছ লোকজনদের, লু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, এটা যদি সেনাবাহিনীর মহাকাশযান হত, তাহলে এতক্ষণে তোমার কোর্ট মার্শাল হয়ে যেত। সুশান, তোমার এত ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, আমাদের এই মহাকাশযান গবেষণার জন্যে হতে পারে, কিন্তু দরকার হলে আমাদের হাজার মাইলের ভিতর যা কিছু আসে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি। কাজেই যতবড় বুদ্ধিমান প্রাণীই আসুক, তোমার কোনো ভয় নেই।
লু মোটেই বাজে কথার মানুষ না, তা ছাড়া একটা অবস্থার গুরুত্ত্ব তার মতো ভালো করে কেউ বুঝতে পারে না, খামোকা তাকে এরকম একটা মহাকাশযানের দলপতি বানানো হয় নি। তাই লুয়ের কথা শুনে সত্যি সত্যি সুশানের চাপা ভয়টা কমে কেমন একটা সাহসের ভাব এসে যায়। সে একটু এগিয়ে মহাকাশযানটাকে কক্ষপথে আটকে ফেলার কাজে লুকে সাহায্য করতে গেল।
মহাকাশযানটিকে তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তন শুরু করাতে দু’জনের প্রায় দশ মিনিট সময় লেগে যায়। কাজটা খুব যে সুচারুভাবে করা হল সেরকম বলা যায় না, প্রথমত কক্ষপথ পুরোপুরি বৃত্তাকার না হয়ে খানিকটা উপবৃত্তাকার হয়ে গেল, দ্বিতীয়ত গ্রহ থেকে দূরত্ব পুরোপুরি এক হাজার কিলোমিটার না হয়ে প্রায় এক শ’ কিলোমিটার বেশি হয়ে থাকল। কম্পিউটার সিডিসিকে ব্যবহার না করে নিজে নিজে চেষ্টা করলে এর থেকে ভালো অবশ্যি কেউ আশা করে না। তবে আজ একটু বাড়তি মজা হল, যখন সুশান কৃত্রিম মহাকর্ষ তৈরি করতে ভুলে যাওয়ায় মিনিট দুয়েক সবাই খানিকক্ষণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। পল কুম তার ভেসে বেড়ানো গরম কফিটাকে মর্গে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। দৃশ্যটি এত হাস্যকর যে, এই নিয়ে হাসাহাসি হৈচৈ করে সবার ভিতরের চাপা অশান্তিটা বেশ একটু কমে আসে।
সিসিয়ানকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে এলে সবাই রুটিনবাঁধা কাজে লেগে যায়, নিজেদের দায়িত্ব কম, সিডিসি নিজেই সব করতে পারে; তবু কেউ-না-কেউ সেটা নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হয়ে নেয়। ছয় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে মহাকাশকেন্দ্রে যোগাযোগ করে সংবাদের আদান-প্রদান হতে থাকে, সিডিসি নতুন পরিবেশের উপযোগী প্রয়োজনীয় খবরাখবর নিয়ে আসতে থাকে। দেখা গেল কাছাকাছি একটা পালসার রয়েছে, সেটিতে ছয় ঘন্টা পরপর একবার করে বিস্ফোরণ ঘটে। তাদের নতুন অবস্থান এই পালসারটিকে কেন্দ্র করে দেয়া হল। নির্দিষ্ট সময় পরপর পালসারের বিস্ফোরণ ঘটে বলে সেগুলি কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রয়োজনীয় কাজকর্ম গুছিয়ে নিতে নিতেই লু তাদের প্রথম আলোচনাসভা ডেকে বসে। কোনো আলোচনা শুরু করার আগে তার সবসময়েই একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস, এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। সে এভাবে শুরু করে, সিসিয়ান সময় সকাল সাড়ে নয়টা, আমাদের আলোচনা শুরু হচ্ছে। আলোচনায় দলের সবাই ছাড়াও অংশ নিচ্ছে সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার সিডিসি। আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ-কর্মপন্থা। তোমরা সবাই জান যে, আমরা একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় এসে পড়েছি। ট্রাইটন নামের যে-গ্রহটাকে সিসিয়ান এখন পাক খাচ্ছে, সেটার কোনো বিশেষ দোষ আছে, যার জন্যে আমাদের সবার, বিশেষ করে যারা জৈবিক প্রাণী, তাদের ভিতরে একটা আশ্চর্য অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে। অকারণ অস্বস্তি জিনিসটা ভালো না, আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না, কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদের দায়িত্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এখানে থাকতে হবে। কারো কিছু বলার আছে?
সবারই কিছু-না-কিছু বলার আছে, তবে বিষয়বস্তু মোটামুটি এক। শুরু করল পল কুম, জিজ্ঞেস করল, আমাদের দায়িত্বটা কি?
যদি গ্ৰহটাতে কোনো প্রাণের বিকাশ না হয়ে থাকে, তা হলে আমাদের দায়িত্ব খুবই কম, সব রুটিনবাঁধা কাজ। ট্রাইটনের আকার, আকৃতি, ভর, তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডল, ঘনত্ব এইসব জিনিস জেনে যেতে হবে। আমাদের তা হলে কিছু করতে হবে না, সিডিসি এক দিনে শেষ করে ফেলতে পারবে। সিডিসি, ঠিক বলেছি কি না?
সিডিসি বিপবিপজাতীয় একটা শব্দ করল, যার অর্থ অনেক কিছু হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সবাই জানে এটা সিডিসির সম্মতিসূচক উত্তর।
আর গ্রহটিতে যদি প্রাণের বিকাশ হয়ে থাকে?