ইউরী উঠে দাড়িয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে বলল, ঘন্টাখানেক সময়ের মাঝে তোমরা দেখবে, ট্রাইটনটি হয়েছে কুচকুচে কালো।
লু একটু ইতস্তত করে বলল, ইউরী, তোমাকে ঠিক কী ভাবে বলব বুঝতে পারছি না, কিন্তু মনে হয় বলে দেয়াটাই উচিত, আমি পুরো সিসিয়ানকে ধ্বংস করে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আর ঘন্টাখানেক সময়ের মাঝে আমাদের সবাইকে নিয়ে পুরো সিসিয়ান ধ্বংস হয়ে যাবে।
ইউরীর মুখ দেখে মনে হল সে ঠিক লুয়ের কথা বুঝতে পারছে না, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে লুয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সিসিয়ানকে উড়িয়ে দেবে?
হ্যাঁ, এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। ট্রাইটনের বংশধরকে কিছুতেই পৃথিবীতে পাঠানো যাবে না। সেটা বন্ধ করার আর কোনো উপায় নেই।
ইউরী ফ্যাকাসে মুখে ফিরে এসে একটা উঁচু মনিটরের উপরে বসে অনেকটা আপন মনে বলল, আমরা সবাই মারা যাব?
আমি দুঃখিত ইউরী।
ইউরী হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, একটা সুপারনোভা৩০ যদি কোনোভাবে তৈরি হত এখন।
কী বললে?
সুপারনোভা। একটা নক্ষত্র যখন সুপারনোভা হয়ে যায়, তখন তার থেকে অচিন্তনীয় নিউট্রিনো বেরিয়ে আসে, হঠাৎ করে যদি অসংখ্য নিউট্রিনো এসে হাজির হয়, তখন ট্রাইটনে যে-তাপের সৃষ্টি হবে, তাতে সে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।
কিন্তু এক শ’ বছরে হয়তো একটা সুপারনোভার জন্ম হয়, আমাদের হাতে সময় এখন এক ঘন্টা।
একটা পালসারও যদি থাকত আশেপাশে।
লু চমকে উঠে বলল, কী বললে তুমি? পালসার?
হ্যাঁ, পালসার। চতুর্থ মাত্রার পালসারে যখন নির্দিষ্ট সময় পরে পরে বিস্ফোরণ হয়, তখনও অসংখ্য নিউট্রিনো বেরিয়ে আসে। সুপারনোভার মতো এত বেশি নয়, কিন্তু অনেক, ট্রাইটনকে শেষ করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট!
লু ইউরীর দিকে ঘুরে বলল, তুমি সত্যি বলছ?
ইউরী একটু অবাক হয়ে বলল, সত্যি না বলার কী আছে?
আমাদের খুব কাছাকাছি একটা পালসার আছে, ছয় ঘন্টা পরপর বিস্ফোরণ হয়, আমি এই পালসারটা দিয়ে আমাদের অবস্থান ঠিক করেছি।
কত দূর এখান থেকে?
বিলিয়ন কিলোমিটারের মতো।
ইউরী লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, মাত্র বিলিয়ন কিলোমিটার? আমাকে আগে বল নি কেন? কোন মাত্রার?
জানি না।
গামা রেডিয়েশানে স্পেকট্রামটা বলতে পারবে?
লু দু’এক কথায় বুঝিয়ে দিতেই ইউরী চিৎকার করে ওঠে, চতুর্থ মাত্রা! চতুর্থ। মাত্রা! আর কোনো ভয় নেই।
নীষা আস্তে আস্তে বলল, তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর যে, ট্রাইটনকে তুমি ধ্বংস করে দিতে পারবে?
অবশ্যি! নিজের হাতে সশব্দে থাবা দিয়ে ইউরী বলল, শুধু আমাকে কয়েক মিনিট সময় দাও।
রু–টেক দরজার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, এবার ঘুরে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দুঃখিত ইউরী, কিন্তু আমাদের হাতে এখন কয়েক মিনিট সময়ও নেই।
কেন?
পাশের ঘরে ট্রাইটনের বংশধর চলে এসেছে, আমাদের এক্ষুণি সরে যেতে হবে।
সরে কোথায় যাব?
আমি ঠিক জানি না।
তুমি বুঝলে কেমন করে, প্রাণীটা এসেছে? প্রচণ্ড রেডিয়েশান হয়। কেন?
মনে হয় তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্যে কোনো একটা তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করে।
আর এই প্রাণীটাকে তোমরা উন্নত বলে দাবি কর? কত বড় নির্বোধ হলে একটা প্রাণী রেডিও একটিভিটি দিয়ে তাপমাত্রা ঠিক করে—
রু-টেক বাধা দিয়ে বলল, আমাদের এক্ষুণি সরে যেতে হবে, প্রাণীটা খুব কাছে চলে এসেছে।
ইউরী ব্যস্ত হয়ে বলল, কিন্তু আমার একটু সময় দরকার যতক্ষণ পর্যন্ত পালসারটাতে আবার বিস্ফোরণ না হচ্ছে, আমার ট্রাইটনের সাথে যোগাযোগ রেখে যেতে হবে।
লু ঘরে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, সবাই স্পেসস্যুট পরে নাও, খুঁটিনাটি ব্যাপারের দরকার নেই, শুধুমাত্র বায়ুনিরোধক অংশটা ঠিক থাকলেই হল, তোমাদের ত্রিশ সেকেন্তু সময় দেয়া হল।
ইউরী মাথা নেড়ে বলল, আমি কখনো স্পেসস্যুট পরি নি, কী ভাবে পরতে হয় আমি জানি না।
লু নীষার দিকে তাকিয়ে বলল, নীষা, তুমি একটু ওকে সাহায্য কর। রু–টেক, তোমার তো কোনো স্পেসস্যুট পরতে হবে না, তুমি কিম জিবান আর সুশানের ক্যাপসুল দু’টি দেখ, সব ঠিক আছে কি না।
পুরো দলটা প্রস্তুত হতে হতে হঠাৎ করে দরজার একটা অংশ ধ্বসে পড়ল, হলুদ রংয়ের একটা ধোঁয়া বাতাসে ভেসে বেড়াতে থাকে। ওরা সবিস্ময়ে দেখে, মেঝের উপর দিয়ে তরল পদার্থের মধ্যে কী—একটা জিনিস এগিয়ে আসছে। ওরা ঘুরে তাকাতেই সেটি থমকে দাড়াল, তারপর হঠাৎ ফুটন্ত পানির মতো শব্দ করতে থাকে। জিনিসটির পৃষ্ঠে আশ্চর্য নকশা খেলা করছে।
ইউরী ভয় পাওয়া গলায় বলল, পালাও, সবাই পালাও—
লু শান্ত স্বরে বলল, যে যেখানে আছ দাঁড়িয়ে থাক, খবরদার নড়বে না।
তা হলে পালাব কেমন করে?
আমি ব্যবস্থা করছি। গুলি করে আমি পিছনের দেয়ালটা ধ্বসিয়ে দিচ্ছি, বাতাসের চাপে ছিটকে বেরিয়ে যাবে সবাই।
কিন্তু–
আর কোনো প্রশ্ন নয় এখন। ইউরী, নিউট্রিনো জেনারেটরটি ছেড়াে না হাত থেকে—
সবাই ঘূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকে। লু আস্তে আস্তে ঘুরে পিছনের দেয়ালের কন্ট্রোল – বক্সের দিকে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি উদ্যত করে। এই বাক্সটির ভিতরে বড় দরজাটি বন্ধ করার যন্ত্রপাতি, উড়িয়ে দিলে পুরো দেয়ালটি উড়ে যাবার কথা। লু সবাইকে একনজর দেখে ট্রিগার টেনে ধরে। প্রচও একটা শব্দ হল, পরমুহূর্তে ওরা সবাই ঘরের সব জিনিসপত্রসহ ছিটকে পড়ে মহাশূন্যে।
০৯. পরিশিষ্ট
লু মহাকাশে ভেসে যাচ্ছিল, বোঝার কোনো উপায় নেই কিন্তু সে জানে যে সে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাচ্ছে। যারা কখনো মহাকাশে ভেসে থাকে নি, তারা কখনোই এই অনুভূতিটি ঠিক বুঝতে পারবে না। লুকে নানা সময়ে নানা পরিবেশে মহাকাশে ভেসে বেড়াতে হয়েছে, তবুও সে এই অবস্থায় কখনো সহজ অনুভব করে না। প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজেকে সামলে নিয়ে সে তার ছোট জেটটি চালু করে, কয়েক মুহূর্তের মাঝেই সে নিজের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে তাদের যোগাযোগের ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে কি না জানা নেই, পরীক্ষা করার জন্যে সে সুইচটি টিপে দেয়, সাথে সাথে ইউরীর আর্তচিৎকার শুনতে পায়, বাঁচাও আমাকে বাচাও, আমি পড়ে যাচ্ছি—