আমি বলামাত্রই গুলি করবে। তের মেগাওয়াট পার্টিকেল বীম প্রায় তিন ফুট ব্যাসের একটা গর্ত করে ফেলবে ছাদে। উপরের ঘরটা এখন বায়ুশূন্য, তোমার ঘর থেকে প্রবল বেগে বাতাস উঠে আসবে, শুরু হবে প্রায় ছয় শ’ কিলোমিটার দিয়ে, সেই বাতাস তোমাদের টেনে আনবে উপরে–
কিন্তু–
তোমরা হয়তো মারা যাবে প্রচণ্ড আঘাতে, কিন্তু আমরা সবাই তো মারা যাব কিছুক্ষণের মাঝে। আমি দুঃখিত, কিন্তু আর কিছু করার নেই কিম। হাত উপরে তুলে রাখ কিম আর সুশান—
লু, শোন, তুমি—
শোনার কিছু নেই, গুলি করতে প্রস্তুত হও কিম, এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে কঠিন স্বরে চিৎকার করে বলল, টানো ট্রিগার।
ভয়ানক একটা বিস্ফোরণ হল মাথার উপরে, গোল একটা গর্ত হয়ে গেল মুহূর্তে। প্রচন্ড বাতাসের ঝাপটায় কিম জিবান আর সুশান গুলির মতো উড়ে গেল উপরে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখে, তারা উড়ে যাচ্ছে বাতাসে, দু’হাতে মাথা বাচিয়ে রাখে তারা, কিন্তু কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড গতিতে আছড়ে পড়ে সিসিয়ানের দেয়ালে, মুহূর্তে জ্ঞান হারালো দুজনেই।
রু-টেক কিম আর সুশানের অচেতন দেই সরিয়ে নেয় সাবধানে, সে বায়ুশুন্য পরিবেশে থাকতে পারে বলে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। মেঝের ফুটো দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বাতাস আসছে, বাতাসের চাপ সমান হওয়ামাত্রই থেমে যাবে। রু–টেক শঙ্কিত দৃষ্টিতে গর্তটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নিচের প্রাণীটি কি উঠে আসবে উপরে? সম্ভবত নয়, ঝুকি নেবে না নিশ্চয়ই।
বাতাসের চাপ সমান হতেই দরজা খুলে যায়, উদ্বিগ্ন মুখে লু আর নীষা অপেক্ষা করছে পাশের ঘরে। রু–টেককে জিজ্ঞেস করল, কি অবস্থা?
ভালো নয়। এখনো বেঁচে আছে দুজনেই। আঘাতটা মাথায় লাগে নি, কাজেই বেচৈ যাবার ভালো সম্ভাবনা ছিল।
ওদের ধরাধরি করে পাশের ঘরে সরিয়ে নিয়ে রু–টেক ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে, ছোটখাটো কয়েকটা ব্যান্ডেজ এদিকে সেদিকে লাগিয়ে দেয় যত্ন করে। ঘন্টাখানেক পরে সবাইকে নিয়ে এই মহাকাশযানটি চিরদিনের মতো ধ্বংস হয়ে যাবে, তবুও চোখের সামনে আহত দু’জনকে কোনোরকম সাহায্য না করে কেমন করে থাকে? নীষা সিসিয়ানের জরুরি ঘর থেকে দু’টি স্টেনলেস স্টিলের ক্যাপসুল নিয়ে আসে, ওরা তিনজন মিলে যখন কিম আর সুশানকে সাবধানে ভিতরে শুইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছিল, ঠিক তখন কাতর শব্দ করে সুশান চোখ খুলে তাকায়, কয়েক যুহূর্ত লাগে তার বুঝতে, কী হচ্ছে। সবকিছু মনে পড়তেই সে ধড়মড় করে উঠে পড়তে চাইছিল, লু সাবধানে শুইয়ে দেয় আবার, বলে, শুয়ে থাক সুশান।
আমরা কি ফিরে যাচ্ছি?
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে সে বলল, হ্যাঁ।
ট্রাইটন আমাদের যেতে দিচ্ছে?
হ্যাঁ।
আমরা তাহলে কেউ মারা যাব না?
না সুশান।
কিন্তু ট্রাইটনের বংশধর–
সেটা নিয়ে কিছু চিন্তা কোরো না, তাকে আমরা রেখে যাচ্ছি।
সত্যি?
সত্যি, তুমি এখন ঘুমাও।
সুশান সাথে সাথে বাধ্য মেয়ের মতো চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষণের মাঝেই ক্যাপসুলের যন্ত্রপাতি সুশানের দায়িত্ব নিয়ে নেবে, তখন সে অনির্দিষ্টকালের মতো ঘুমিয়ে থাকতে পারবে। যদি সত্যি সত্যি সুশান বিশ্বাস করে যে সে এখন পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছে, মন্দ কি? একটা সুখ-স্বপ্ন নিয়ে নাহয় কাটাক জীবনের শেষ সময়টক।
ওরা যখন কিম জিবানের অচেতন শরীরকে ক্যাপসুলের মাঝে শুইয়ে দিচ্ছিল, তখন হঠাৎ ইউরী এসে হাজির হল, তার চোখ-মুখে উত্তেজনার ছাপ, ওদের কাজে কোনোরকম কৌতূহল না দেখিয়ে বলল, ট্রাইটনের রং আস্তে আস্তে গাঢ় লাল রঙের হয়ে যাচ্ছে, খেয়াল করেছ?
লোকটার উপরে রাগ করবে ভেবেও লু ঠিক রাগ করতে পারে না, একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ। ভারি মজার ব্যাপার।
মজার কী হল এখানে?
মজার হল না? আমি এখানে বসে তাকে জিজ্ঞেস করি সুপার সিমেট্রিক বোনের ভর, আর সে তার উত্তর না দিয়ে টকটকে লাল হয়ে যায়।
উত্তর হয়তো জানে না, তাই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।
লুয়ের রসিকতাটুকু ইউরী ধরতে পারল না, মাথা নেড়ে বলল, না না, লজ্জা নয়, বাড়তি উত্তাপটুকু বিকিরণ করার জন্যে গায়ের রং ওরকম গাঢ় লাল করেছে।
নীষা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, বাড়তি উত্তাপ কিসের?
নিউট্রিনো থেকে পাচ্ছে।
লু অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে বলল, আমাদের নিউট্রিনো জেনারেটর দিয়ে মেগাওয়াট পাওয়ার বের হয় কিনা তাতে সন্দেহ আছে, আর তুমি বলছ সেটা পুরো টাইটনের ভাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে?
ইউরী একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, না না, তুমি বুঝতে পারছ না, ট্রাইটন তার শরীরে একটা নিউট্রিনো ডিটেকটর তৈরি করেছে, তাই সে আমাদের পাঠানো সিগন্যাল দেখতে পায়। কিন্তু নিউট্রিনোর তো অভাব নেই, শুধুমাত্র সূর্য থেকে যে-পরিমাণ নিউট্রিনো বের হয় সেটার জন্যে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের শরীর দিয়ে সেকেন্ডে কয়েক লিওন করে নিউট্রিনো পার হয়ে যায়। এখানকার কথা ছেড়েই দাও। ট্রাইটনকে আমাদের অল্প কয়টা নিউট্রিনোর সাথে সাথে আরো ট্রিলিওন ট্রিলিওন নিউট্রিনো দেখতে হচ্ছে, ঐসব নিউট্রিনো থেকে যে-তাপ বের হয়, সেটা ট্রাইটনকে গরম করে ফেলতে পারে।
লু অস্বীকার করতে পারে না যে, ব্যাপারটুকু সত্যি হলে নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ।
ইউরী হঠাৎ কী-একটা ভেবে বলল, ভারি মজার একটা পরীক্ষা করা যায়। আমি যদি নিউট্রিনোর সংখ্যা কমাতে থাকি, ট্রাইটনাকে তার ডিটেকটরটি আরো সংবেদনশীল করতে হবে, ফলে সে আরো বেশি নিউট্রিনে দেখবে, কাজেই পুরো ট্রাইটন আরো বেশি গরম হয়ে উঠবে। তাপ বিকিরণ করার জন্যে তখন ট্রাইটনকে হতে হবে কুচকুচে কালো।