বেশ।
সুশান আস্তে আস্তে বলল, অপেক্ষা করা খুব ভয়ংকর ব্যাপার, বিশেষ করে সেটা যদি শেষ সময়ের জন্যে হয়।
কী ভাবে বংশধরকে খুঁজে বের করা হবে, সেটা নিয়ে এক দুই মিনিট কথা বলে নেয়া হল। সিসিয়ানে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে মাত্র দু’টি, কাজেই একসাথে দু’টির বেশি দল যেতে পারবে না। ঠিক করা হল, এক দিকে যাবে কিম জিবান আর সুশান, অন্য দিকে লু আর নীষা। সিডিসি নেই বলে দুই দলে যোগাযোগ রাখা ভারি কঠিন ব্যাপার, রু-টেক তাই কন্ট্রোল রুমে বসে সেই দায়িত্ব পালন করার দায়িত্ব নিল। রু-টেক বংশধরকে খুঁজে বের করতে ওদের থেকে অনেক বেশি কার্যকর হত সন্দেহ নেই, কিন্তু এই শেষ মুহূর্তে কেউ চুপচাপ বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতে চাইছিল না। রু-টেক রবোট, সে তার ভয়ের সুইচটি বন্ধ করে সানন্দে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে পারে।
প্রস্তুত হতে হতে ওদের আরো কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল। সিসিয়ানের মোট তিনটি স্তর রয়েছে। পল কুমের মৃতদেহ রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় স্তরে, তাই ঠিক করা হল সেটাই আগে দেখা হবে। পুরো এলাকাটি অনেক বড়, খুঁটিনাটি যন্ত্রপাতি এবং নানা ধরনের জিনিসপত্রে বোঝাই। সিডিসি না থাকায় এই স্তরে আলো নিস্পভ, কোথাও কোথাও একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পলের মৃতদেহ যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে ওরা শুরু করে, লু নীষাকে নিয়ে রওনা দিল সামনের দিকে, কিম জিবান সুশানকে নিয়ে পিছন দিকে। ওদের মাথায় লাগানো উজ্জ্বল আলো, ইচ্ছে করলে জ্বালাতে পারে, আবার ইচ্ছে করলে নিভিয়ে দিতে পারে। কানে ছোট হেডফোনে রু-টেকের মাধ্যমে অন্য দলের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা। আপাতত নীষা আর কিম জিবান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দু’টি নিয়ে হাঁটছে, যেটুকু ওজন হলে অস্ত্রটি সহজে টেনে নেয়া যেত এগুলি তার থেকেও বেশ খানিকটা ভারি, তাই ঠিক করা হয়েছে কিছুক্ষণ পরে পরে হাতবদল করা হবে।
ওরা নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়ায়, একজন লাথি দিয়ে আচমকা দরজা খুলে দিয়েই সরে যায়, অন্যজন বিদ্যুৎগতিতে অস্ত্র তাক করে ঘরে ঢুকে পড়ে। মাথায় লাগানো উজ্জ্বল আলোতে ঘরটা ভরে যায়, ওরা তখন লক্ষ করার চেষ্টা করে, হঠাৎ করে ঘরের ভিতরে কিছু নড়ে গেল কি না, কোনো কিছু সরে গেল কি না। তন্নতন্ন করে ওরা অস্বাভাবিক কিছু একটা খুঁজতে চেষ্টা করে। প্রাণীটা দেখতে কেমন, কত বড়, কোনো ধরনের ধারণা নেই, তাই ভালো করে ওরা জানেও না, ঠিক কী খুঁজছে। ভিতরে ভিতরে ওদের একটা অশরীরী আতঙ্ক, প্রতিবার একটা দরজা খুলে ঢোকার আগে ওদের একজনের আরেকজনকে সাহস দিতে হয়, ভিতরে ঢুকে যখন দেখে কিছু নেই, ওরা তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
ঘন্টাখানেক কেটে যায় এভাবে, কিছু দেখতে পাবে তার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। এমনিতে ব্যাপারটিতে কষ্টকর কিছু নেই, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে অজানা একটা আতঙ্ক নিয়ে কাজ করা ভারি যন্ত্রণাদায়ক, মানুষ এরকম অবস্থায় খুব তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে যায়। অন্য সময় হলে ওৱা থেমে বিশ্রাম নিত, কিন্তু আজ অন্য ব্যাপার। টিকটি করে ঘড়িতে সময় বয়ে যাচ্ছে, যতক্ষণ তারা এই অমানুষিক কাজে নিজেদের ডুবিয়ে রাখতে পারে, ততক্ষণ ওদের মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করার দুরূহ কাজটি করতে হয় না। তবু হয়তো তারা খানিকক্ষণের জন্যে থামত, কিন্তু হঠাৎ করে তারা বংশধরের সাক্ষাৎ পেয়ে গেল।
সুশান ঘরের দরজাটি লাথি মেরে খুলে সরে যাবার আগের মুহূর্তে বলল, সাবধান।
কিম জিবান থমকে দাঁড়ায়। সামনে তাকিয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল, ঘরটির মেঝের অংশবিশেষ কেউ খুব সাবধানে যেন কেটে নিয়েছে। কাটা অংশ দিয়ে নিচের স্তর দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না।
রু-টেকের গলার স্বর শোনা গেল, কী হয়েছে?
এখনো জানি না। ঘরটার জায়গায় জায়গায় কেউ কেটে নিয়েছে, প্রাণীটাই হবে নিশ্চয়ই।
দেখা যাচ্ছে প্রাণীটাকে?
ওরা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে খোঁজার চেষ্টা করে প্রাণীটাকে, কিন্তু কোথাও কিছু নেই। কিম জিবান আস্তে আস্তে বলল, এখনো দেখছি না।
কী করবে এখন তুমি?
ভিতরে গিয়ে খুজব।
যে-প্রাণী স্টেনলেস স্টিল আর টাইটেনিয়ামের দেয়াল কেটে নিতে পারে, সেটার সাথে লড়তে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয় কিম।
তা ঠিক, কিন্তু কী করব বল? তুমি বরং লুকেও আসতে বল এদিকে।
বলছি।
কিম জিবান লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে শক্ত হাতে অস্ত্রটিকে ধরে ঘরের ভিতরে এক পা ঢোকে, সাথে সাথে সরসর করে কোথায় জানি কি একটা শব্দ হল, মনে হল কিছু একটা যেন হঠাৎ বাম দিকে সরে গেছে।
কিম জিল বাম দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে সাবধানে আরো এক পা এগিয়ে যায়। পিছনে পিছনে সুশান এসে ঢোকে, উত্তেজনায় তার বুকের ভিতরে ঢাকের মতো শব্দ হচ্ছে, ফিসফিস করে বলল, কিছু-একটা আছে বাম দিকে।
বাম দিকে সিসিয়ানের দেয়াল, নানা ধরনের পাইপ, বৈদ্যুতিক এবং অপটিকেল তারগুলি ওদিক দিয়ে গিয়েছে। ছোটখাটো একটা যন্ত্রপাতির স্তর রয়েছে ওপাশে, তার পিছনে কিছু-একটা আশ্রয় নিয়েছে বলে মনে হয়। আবছা অন্ধকার ওখানে, ভালো করে দেখা যায় না। কিম জিবান আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে সাবধানে এগিয়ে যায়, সাথে সাথে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল, প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ে সে একপাশে, কয়েক মুহূর্ত সে কিছু বুঝতে পারে না কি হচ্ছে। সাবধানে উঠে দাঁড়ায় কিম জিবান, ঘরে হলুদ রঙের ধোয়া, ঝাঁঝাল গন্ধে ঘর ভরে গেছে, খকখক করে কাশতে থাকে সে। সামনে গোলাকার আরেকটা গর্ত। একটু আগেও সেখানে কিছু ছিল না। পিছনে তাকিয়ে দেখে, সুশান ফ্যাকাসে মুখে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।