লু নিজের ঘরে মাথা চেপে বসে আছে, এখন কী করবে সে? ট্রাইটন তার বংশধরকে সিসিয়ানে পাঠিয়ে দিয়েছে, এখন তাকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাবার কথা। সিসিয়ানে সিভিসি নেই, কাজেই এখন ফিরে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। সিসিয়ানকে চালিয়ে নেবার জন্যে ট্রাইটনের এখন কী পরিকল্পনা, কে জানে? লু চিন্তা করার চেষ্টা করে, সে ট্রাইটন হলে কী করত? প্রথমত, নিশ্চিত করার চেষ্টা করত বাইরের কেউ যেন জানতে না পারে এখানে ট্রাইটনের বংশধর রয়েছে, যাকে এখন পৃথিবীতে নেয়ার কথা। কাজেই চেষ্টা করত সবাইকে মেরে ফেলতে, তার বংশধর খুব সহজেই সেটা করতে পারে, কিন্তু করছে না। কাজেই ধরে নেয়া যায়, ট্রাইটন সেটা চাইছে না। চাওয়ার কথাও নয়, কারণ তাহলে সিসিয়ান ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সিসিয়ানকে এখন পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতে চাইবে, কী ভাবে সেটা সম্ভব? ট্রাইটন এখন তাদের বাধ্য করবে বাইরের কোনো জীবিত প্রাণীর সাথে যোগাযোগ না করে তাদের পৃথিবীতে পাঠানোর। কী ভাবে করবে সে?
এই সময় দরজায় কার জানি ছায়া পড়ে, লু তাকিয়ে দেখে, নীষা ফ্যাকাশে মুখ দাঁড়িয়ে আছে।
কি হয়েছে নীষা?
ইউরী–
কী হয়েছে ইউরীর?
আমাকে এসে বলেছে ট্রাইটনে একটা খবর পাঠাতে। আমি রাজি হই নি, তখন কোথা থেকে একটা রিভলবার জোগাড় করে এনে আমার মাথায় ধরেছে।
মাথায়? লু চমকে উঠে বলল, কেন?
বলেছে নিউট্রিনো জেনারেটরটি ট্রাইটনের দিকে মুখ করে ধরতে।
ট্রাইটনের দিকে?
হ্যাঁ।
কেন?
ইউরী ট্রাইটনের কাছে খবর পাঠাতে চায়, ওর নাকি জিটা বোজানের উপরে কী একটা সমস্যা আছে।
লু তার জীবনে কখনোই হঠাৎ করে রেগে ওঠে নি, কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হল, হঠাৎ করে তার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। সে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাড়িয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, কোথায় সেই বদমাশ?
লু।
কি?
ওর কাছে একটা রিভলবার আছে।
রিভলবারের নিকুচি করি আমি—লু ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। সিসিয়ান ছাড়া ছাড়াভাবে দুলছিল, তার মাঝে তাল সামলে লু হেঁটে যেতে থাকে। কোনার ঘরটাতে ইউরী দরজা বন্ধ করে আছে, লু লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে।
ইউরী উবু হয়ে যেন কি করছিল, লুকে দেখে চমকে উঠে দু’হাতে রিভলবারটি চেপে তুলে ধরে, ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলে, সাবধান, গুলি করে দেব।
লু ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা এগিয়ে যায়, উদ্যত রিভলবারটি পুরোপুরি উপেক্ষা করে সে ইউরীর কলার চেপে ধরে বলে, তুমি আমাকে গুলির ভয় দেখাও? কর দেখি গুলি, তোমার কত বড় সাহস।
ইউরী একেবারে হকচকিয়ে যায়, নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু-একটা বলতে চাইছিল, লু তাকে সুযোগ না দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধমকে ওঠে, তুমি ট্রাইটনে খবর পাঠাতে ঢাইছ আমার অনুমতি ছাড়া? তুমি জান এটা একটা মহাকাশযান, আর আমি এই মহাকাশযানের দলপতি? আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে ট্রাইটনে ছুড়ে দিতে পারি? কাউকে আমার কৈফিয়ত পর্যন্ত দিতে হবে না?
ইউরী নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে, রিভলবারটা একপাশে সরিয়ে রেখে বলল, আমি খুব দুঃখিত, তোমরা যে ব্যাপারটা এভাবে নেবে, আমি বুঝতে পারি নি।
বুঝতে পার নি? তুমি একজনের মাথায় রিভলবার ধরে ভয় দেখিয়ে কাজ করিয়ে নেবে আর আমরা সেটা সহজভাবে নেব?
ইউরী দুর্বলভাবে হেসে বলল, রিভলবারে গুলি নেই, তয় দেখানো ছাড়া এটা আর কোনো কাজে আসে না। আমি মেয়েটাকে বললাম, চল, ট্রাইটনে একটা খবর পাঠানোর চেষ্টা করে দেখি, মেয়েটা রাজি হল না—
তাই তুমি তার মাথায় রিভলবার চেপে ধরলে?
বলেছি তো গুলি নেই, একটু ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিলাম। কী করব বল, এমনিতে রাজি না হলে আমি কী করব?
তোমার ট্রাইটনের সাথে যোগাযোগ করার এত কী প্রয়োজন?
এই নিউট্রিনো জেনারেটর দিয়ে তোমরা দূরে কোথাও যোগাযোগ করতে পারবে, একমাত্র যোগাযোগের চেষ্টা করতে পার ট্রাইটনের সাথে, সে কাছে আছে, মাত্র হাজার কিলোমিটার। তার সাথে যোগাযোগ করতে কোনো ক্ষতি তো নেই। যদি সত্যি বুদ্ধিমান প্রাণী হয়, মুখোমুখি কথা বলতে ক্ষতি কী, হয়তো তাকে কিছু একটা বোঝাতে পারব।
পেরেছ?
না। তাকে বলেছি সে যদি আমাদের সংকেত বুঝতে পারে তা হলে যেন বড় লাল বৃত্তটি আস্তে আস্তে ছোট করে ফেলে।
করেছে?
না, করে নি।
ও। লু কি বলবে বুঝতে পারে না, খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, ইউরী তাকে ডাকল, লু।
কি হল।
আমি কি ট্রাইটনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে পারি?
লু একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার ইচ্ছে।
করিডোর ধরে হেঁটে যেতে যেতে লু দেখল, নীষা একটা গোল জানালার পাশে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। লুকে দেখে আস্তে আস্তে বলল, ট্রাইটনকে দেখেছ?
কী হয়েছে?
বড় লাল বৃত্তটি কেন জানি আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে।
০৮. বংশধর
ট্রাইটনের সাথে কথাবার্তা হল খুব সংক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলি করতে হল এমনভাবে, যেন হাঁ কিংবা না বলে উত্তর দেয়া যায়। হা হলে বড় বৃত্তটি বড় করবে, না হলে ছোট। এভাবে কথোপকথন করা খুব কষ্ট, কিন্তু তবু ওরা চেষ্টার ত্রুটি করল না। খুব বেশি লাভ হল না, কারণ ট্রাইটন হ্যাঁ কিংবা না কোনো উত্তরই বেশিক্ষণ দিতে চাইল না।
প্রথম প্রশ্ন করল লু জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমাদের যেতে দেবে?
না।
তুমি আমাদের সাথে সহযোগিতা করতে চাও?
কোনো উত্তর নেই।
আমাদের সভ্যতা নিয়ে তোমার কোনো কৌতূহল আছে?