লু মাথা নেড়ে বলল, মনে হয় না এটা ট্রাইটন বুঝতে পারবে, আমি নিউট্রিনো সম্পর্কে খুব বেশি জানি না, কিন্তু যেটুকু জানি তা থেকে এটুকু বলতে পারব, লক্ষ লক্ষ নিউট্রিনো ট্রাইটনের ভিতর দিয়ে চলে যাবে, ট্রাইটন টের পর্যন্ত পাবে না।
ইউরী কখন ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ দেখে নি। তার চাপা হাসি শুনে সবাই ঘুরে তাকাল। লু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কি, আমি ভুল বলেছি?
না। কিছু ভুল বল নি। এটা ধরে নেয়া মোটেও ভুল নয় যে ট্রাইটন তার শক্তির জনো উইক ইন্টারঅ্যাকশান ব্যবহার করে না।
তা হলে হাসছ কেন?
ইউরী আঙুল দিয়ে ছেলেমানুষি যন্ত্রটাকে দেখিয়ে বলল, ওটা দেখে। ওটা দেখে হাসার কী হয়েছে?
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখুন পদার্থবিজ্ঞান ক্লাসে আমার এইরকম একটা যন্ত্র ব্যবহার করে একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়েছিল।
তাতে কী হয়েছে?
এটা একটা ছেলেমানুষি জিনিস, ল্যাবরেটরিতে কমবয়সী ছাত্রেরা এসব দিয়ে কাজ করে, এটার কোনো ব্যবহারিক গুরুত্ব নেই। কেউ–একজন ঠাট্টা করে এটা এখানে রেখেছে।
ইউরী সত্যি বলছে, না ঠাট্টা করছে, তারা বুঝতে পারল না। কিম জিবান একট রেগে বলল, বাজে কথা বলো না, এরকম ব্যাপার নিয়ে কেউ ঠাট্টা করে না।
দেখতেই পাচ্ছ কেউ কেউ করে।
তুমি বলতে চাইছ, এটা কাজ করে না?
না, কাজ করবে না কেন, অবশ্যি করে।
তা হলে?
কাজ করলেই তো হয় না, যেটার যে-কাজ, সেটা তার থেকে বেশি তো করতে পারে না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কত নিউট্রিনো আছে, জান? এই মুহূর্তে তোমার শরীর দিয়ে সেকেন্ডে অন্তত এক বিলিয়ন নিউট্রিনো যাচ্ছে, তুমি টের পাও না, কারণ সেগুলি তোমার শরীরের সাথে কোনোরকম বিক্রিয়া করছে না। এই নিউট্রিনো জেনারেটরটা সেকেন্ডে খুব বেশি হলে মিলিয়নখানেক নিউট্রিনো তৈরি করতে পারে, সেটা কি কয়েক বিলিয়ন মাইল দূর থেকে কেউ ধরতে পারবে? বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে মানি, কিন্তু সব কিছুরই তো একটা মাত্রা আছে।
সুশান একটু সন্দেহ নিয়ে ইউরীর দিকে তাকিয়ে ছিল, ইউরী সেটা লক্ষ করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হল না?
কেউ তার কথার উত্তর দিল না। ইউরী মাথা ঘুরিয়ে একবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি পদার্থবিজ্ঞানের লোক, সারা জীবন আমি নিউট্রিনো নিয়ে কাজ করে এসেছি।
সবাই চুপ করে ইউরীর দিকে তাকিয়ে থাকে, ইউরী একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, তোমরা এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ, যেন দোষটা আমার। আমি তো কিছু করি নি। একটা মিথ্যা আশা নিয়ে থাকা থেকে সত্যি কথাটা জানা কি ভালো নয়?
নীষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারলাম না, এরকম একটা অযৌক্তিক ব্যাপার কেন করা হবে? কেন একটা মহাকাশযানে একটা খেলনা নিউট্রিনো জেনারেটর রাখা হবে?
সেটা আমাকে খুব অবাক করছে না, লু একটু হেসে বলল, মানুষ প্রথম যখন মঙ্গল গ্রহে গিয়েছিল, তারা সাথে কী নিয়ে গিয়েছিল জান?
কী?
রিভলবার। সেটা কখন কোথায় কী ভাবে ব্যবহার করবে কেউ জানত না, তবু নিয়ে গিয়েছিল। কাজেই অযৌক্তিক জিনিস মানুষের কাছে আশা করা এমন কিছু বিচিত্র ব্যাপার নয়। এখানেও হয়তো সেরকম কিছু-একটা হয়েছে। এই নিউট্রিনো জেনারেটরটা হয়তো সেই রিভলবারের মতো কাজ করে, কিন্তু কোনো কাজে আসে না।
সুশান আস্তে আস্তে বলল, মনে হয় একটু মিথ্যে আশা দেয়ার জন্যে এটা রাখা হয়েছে। দেখা গেছে, মানুষকে অল্প একটু আশা দিয়ে অনেক আশ্চর্য কাজ করিয়ে নেয়া যায়।
কিম জিবান শুল্কমুখে বলল, তাহলে আমরা কি এটা ব্যবহার করব না?
ব্যবহার করব না কেন, অবশ্যি ব্যবহার করব, তবে এর থেকে কিছু আশা করব না। নেহায়েত যদি আমাদের ভাগ্য খুব ভালো হয়, খুব কাছে দিয়ে যদি একটা মহাকাশযান যায়, হয়তো আমাদের সংকেত শুনে আমাদের সাহায্য করতে আসবে।
ইউরী হাসি গোপন করার কোনো চেষ্টা না করে বলল, এর থেকে একটা রিভলবার দিয়ে কয়েকবার ফাঁকা আওয়াজ করা ভালো, শব্দ শুনে কারো আসার সম্ভাবনা মনে হয় একটু বেশি হতে পারে।
কথাটি একটি রসিকতা মাত্র, কিন্তু যুক্তিসঙ্গত কারণেই কেউই সেই রসিকতাটুকু উপভোগ করতে পারল না।
খানিকক্ষণ আলোচনা করে নীষাকে এই নিউট্রিনো জেনারেটরটি চালু করার ভার দেয়া হল, সে চারদিকে বিপদগ্রস্ত মহাকাশযানের সংকেত পাঠাতে থাকবে। নিউট্রিনো রশ্মি সেই সংকেত সত্যি সত্যি নিয়ে যাবে বিলিওন বিলিওন মাইল দূরে, কেউ সেটা পাবে কিনা, কে বলতে পারে? ইউরী বলছে পাবে না, বিজ্ঞানের বর্তমান উৎকর্ষতায় পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু কেউ তো পেতেও পারে, আশা করতে তো দোষ নেই, মানুষের আশা যদি না থাকে, তা হলে তারা বেঁচে থাকবে কী নিয়ে?
নীষা ধৈর্য ধরে নিউট্রিনো রশ্মি পাঠাতে থাকে, চেষ্টা করছে চারদিকে পাঠাতে, বিশেষ করে যেদিকে মহাকাশকেন্দ্র রয়েছে, সেদিকে। খুব সাবধানে সে ট্রাইটনকে এড়িয়ে চলছিল, যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই অবস্থায় সে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। নীষা এবং অন্য সবাই আশা করেছিল যে, ইউরীর ধারণা সত্যি নয় এবং নিউট্রিনো রশ্মি চালু করা মাত্রই দূর মহাকাশ কেন্দ্র থেকে সাহায্য এসে যাবে। কিন্তু তাদের ধারণা সত্যি নয়, দেখতে দেখতে সময় কেটে যেতে থাকে, কিন্তু কোনো মহাকাশযানই তাদের উদ্ধার করার জন্যে হাজির হয় না। যতই সময় যাচ্ছে ততই তারা বুঝতে পারছে, আসলে ইউরীর কথাই সত্যি, এই নিউট্রিনো জেনারেটরটি একটি খেলনা ছাড়া আর কিছু নয়।