তা ঠিক। রু-টেক হার মানে, সত্যি কথা বলতে কি, গ্রহটাকে দেখতে খারাপ লাগছে, কিন্তু ঠিক অশুভ মনে হচ্ছে না। তার কারণ অশুভ বলতে তোমরা কী বোক্সাও, আমি ঠিক জানি না। কিন্তু খারাপ লাগাটাই কি যথেষ্ট নয়?
পল কুম মাথা নেড়ে বলল, না, যথেষ্ট নয়। কিম জিবান তার দেয়ালে যে-ছবি আঁকে, সেটা দেখতে তোমার আমার সবারই খারাপ লাগে, সুশান সেদিন যে-স্যুপটা বেঁধেছিল, সেটাও যথেষ্ট খারাপ ছিল—
সুশান আর কিম জিবান একসাথে পল কুমকে থামিয়ে দেয়। কিম জিবান গলার স্বরে একটা আহত ভাব ফুটিয়ে বলল, আমার আঁকা ছবি কি এত খারাপ যে, সেটাকে সুশানের স্যুপের সাথে তুলনা করতে হবে?
সবাই একসাথে হেসে ওঠে, সুশানও। কিম জিবানের বিমূর্ত ছবি নিয়ে মতভেদ আছে কিন্তু স্যুপটা আসলে এমন কিছু খারাপ হয় নি, ঠাট্টা করার জন্যে বলা হয়।
রু-টেক আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসে, তাহলে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হল? আমরা গ্রহটাতে যাচ্ছি?
লু মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, যাচ্ছি। তুমিও যদি বলতে গ্রহটাকে অশুত লাগছে, তাহলে ফিরে যাওয়ার একটা সুযোগ ছিল।
আমাকে কেন টালহু, রু-টেক বলল, আমি একটা যন্ত্র, তোমাদের ঐ ডিটেক্টর বা পাওয়ার জেনারেটরের মতো। পাওয়ার জেনারেটরের বক্তব্যের যদি কোনো মূল্য না থাকে, আমার বক্তব্যের মূলা থাকবে কেন?
পল কুম রু-টেকের ঘাড়ে থাবা দিয়ে বলল, কেন এখনো খামোকা চেষ্টা করে যাচ্ছ? তুমি জান তুমি দলের একজন, সত্যি কথা বলতে কি পুরো দলে একজন যদি স্বাভাবিক মানুষ থাকে, যার একটু জ্ঞানবুদ্ধি বা রসবোধ আছে, সেটা হচ্ছ তুমি। আর মহাকাশযানের এগার নম্বর ধারার চার নম্বর অংশে স্পষ্ট বলা আছে, মহাকাশযানে যদি ষষ্ঠ মাত্রার কোনো রৰােট থাকে, তাহলে তাকে মানুষের সমান মর্যাদা দিয়ে দলের সদস্য হিসেবে নিতে হবে।
রু-টেক চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, আমি দুঃখিত যে, আমার জনো তোমাদের সবার গ্রহটাতে যেতে হচ্ছে। কেউ একজন কি আমাকে আজ রাতের মাঝে শিখিয়ে দিতে পারবে কী ভাবে অশুভ অনুভব করতে হয়?
সুশান বলল, খুব ভালো আছ তুমি, খামোকা এই বয়সে মূতল একটা জিনিস শিখতে যেও না।
রবোটের হিসেবে আমার বয়স খুব বেশি নয় সুশান, আমাদের শৈশব শুরু হয় চল্লিশ বছরের পর!
বেশ, তাহলে অন্তত কৈশোরের জন্যে অপেক্ষা কর।
রু-টেক কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটু সরে গিয়ে মনিটরটির দিকে তাকায়, নিজের অজান্তে তার সবুজ চোখের ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যেতে থাকে।
পল কুম একটু এগিয়ে লুয়ের কাঁধে টোকা দিয়ে বলল, লু।
কি?
আমার কি মনে হয় জান?
কি?
এই গ্রহে খুব উন্নত একটা প্রাণী আছে।
লু ঘুরে তাকিয়ে বলল, কেন ওরকম ভাবছ?
পল কুম গলার স্বর নিচু করে বলল, রু-টেক ছাড়া সবার ভিতরে কেমন একটা চাপা ভয় দেখেছ? এরকম অনুভূতি শুধু একটা জীবিত প্রাণী আরেকটা জীবিত প্রাণীর ভিতরে সঞ্চারিত করতে পারে। ব্যাপারটা কীভাবে হয় ঠিক জানা নেই, পৃথিবীতে কয়েক জায়গায় এর উপরে কাজ হচ্ছে। জিনিসটাকে টেলিমরবিজম বলে। তুমি নিশ্চয়ই আগে লক্ষ করেছ, একজন মানুষের মনে যখন খুব কষ্ট হয়, তখন তার সাথে কথা না বলে, শুধু তার পাশে বসে সেটা অনুভব করা যায়?
লু অন্যমনক্কতাবে মাথা নাড়ে। মনোবিজ্ঞান সে ভালো বোঝে না, কোনটি বিজ্ঞান আর কোনটি কল্পনা সে এখনো ভালো ধরতে পারে না।
মহাকাশযান সিসিয়ানের কন্ট্রোল–ঘরটি হঠাৎ দেখলে মনে হবে সেখানে কেউ নেই। যে-মহাকাশযান চালানোর জন্যে প্রায় তিন হাজার ছোট-বড় কম্পিউটার কাজ করে, সেখানে কারো থাকার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তবুও সবসময়েই সেখানে কেউ-না-কেউ থাকে। আজ সেখানে আছে কিম জিবান। কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে আরামদায়ক চেয়ারটাতে সে প্রায় ডুবে আছে, পা তুলে দিয়েছে মনিটরটির উপরে, দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে মনিটরটির দিকে। ঘরটিতে আবছা অন্ধকারে মনিটরটির রঙিন আলো ছাড়া আর কিছু নেই। সবাই বিশ্রাম নিতে গিয়েছে, তাদের মহাকাশযান সিসিয়ানের গ্রহটির মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার ভিতরে না আসা পর্যন্ত কারোরই বিশেষ দায়িত্ব নেই। সে যদিও মহাকাশযানের ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে বাড়াবাড়ি কৌতূহল বলে নিজের উৎসাহে কন্ট্রোলরুমে সময় কাটানোর দায়িত্ব নিয়েছে।
যে-গ্রহটির দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে, সেটির নাম ট্রাইটন। এটি অবশ্যি তার সত্যিকার নাম নয়, গ্রহটির সত্যিকার নাম হচ্ছে একটি বিদঘুটে সংখ্যা। সংখ্যাটি বিদঘুটে হলেও অর্থহীন নয়, প্রথম ছয়টি সংখ্যা দিয়ে তার অবস্থান, এবং পরের চারটি দিয়ে তার আকার-আকৃতি প্রকাশ করা হয়। অনুসন্ধানকারী কোনো দল যখন কোনো গ্রহে অভিযানে বের হয়, তখন তাদেরকে বিদঘুটে সংখ্যা ছাড়াও ব্যবহার করার জন্যে গ্রহটির একটি সাময়িক নাম দিয়ে দেয়া হয়। অভিযান শেষ হবার পর নামটিও শেষ হয়ে যায়, যারা অভিযানে অংশ নেয় তারা হয়তো আরো কিছুদিন মনে রাখে, কিন্তু তার বেশি কখনো কিছু নয়।
এই আশ্চর্য গ্রহ ট্রাইটনের দিকে যতই তারা এগিয়ে যাচ্ছে, আর সবার মতন তার ভিতরেও একটা বিতৃষ্ণা এবং চাপা ভয় জেগে উঠছে, কিন্তু সাথে সাথে তার ভিতরে জেগে উঠছে একটা আশ্চর্য কৌতূহল। গ্রহটির যতই কাছে আসছে ততই তার বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছে, গ্ৰহতত্ত্বের প্রচলিত প্রায় সবগুলি নিয়ম এখানে অচল। প্রথমে ধরা যাক ঘনত্ব, এই আকারের একটা গ্রহের যে পরিমাণ ঘনত্ব থাকা দরকার, ট্রাইটনের ঘনত্ব তার থেকে অনেক কম, পুরো গ্রহটি যেন হালকা তুলো দিয়ে তৈরি। গ্রহ-উপগ্রহে মাধ্যাকর্ষণের জন্যে কেন্দ্রে ঘনত্ব বেশি হয়, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সেটি এই গ্রহের জন্যে সত্যি নয়। গ্রহটি ঘুরছে খুব ধীরে ধীরে, কিন্তু ঘূর্ণনটি কখনোই ঠিক নিয়মিত নয়। অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু গ্রহটির ঘূর্ণন যেন মাঝে মাঝে পুরোপুরি থেমে যাচ্ছে, এ-ধরনের ব্যাপার ঘটতে হলে গ্রহের ভিতরে যে-রকম প্রলয়কাণ্ড ঘটা উচিত, বাইরে থেকে সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। ট্রাইটনের বায়ুমণ্ডল বলতে গেলে নেই, যা আছে সেটি অত্যন্ত বড় বড় পলিমার। ট্রাইটনের পৃষ্ঠে বড় বড় গোলাকার গর্ত, সিসিয়ানের রিপোর্ট সত্যি হলে সেগুলি শুধু যে আকার পরিবর্তন করছে তাই নয়, ক্রমাগত নাকি স্থানও পরিবর্তন করছে।