সে জন্যে যদি আমাদের কোনো-একজনকে প্রাণ দিতে হয়, দেব।
সুশান মাথা নেড়ে বলল, আমি বুঝতে পারছি না, তুমি কী বলছ।
বলছি, যদি একজনের প্রাণ দিয়ে অন্যদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়, তাকে প্রাণ দিতে হবে।
কিম বাধা দিয়ে বলল, কী বলছ তুমি, লু? কার প্রাণ দিয়ে তুমি অন্যদের বাঁচাবে?
লু হাত তুলে কিমকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সিডিসি, তুমি বলতে পার, সে-রকম কেউ কি আমাদের মাঝে আছে
সিভিলি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে।
সিডিসি।
সিডিসি তবু কথা বলে না।
সিডিসি, আমার কথার উত্তর দাও।
সিডিসি আস্তে আস্তে প্রায় ফিসফিস করে বলল, লু সত্যি তুমি তাই চাও?
হ্যাঁ সিডিসি।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
সত্যি তুমি চাও আমি প্রাণ দিই?
আমি দুঃখিত সিডিসি। ট্রাইটনের আমাদের কাউকে প্রয়োজন নেই, তার প্রয়োজন শুধু তোমাকে। তুমি জান, ট্রাইটন তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, অন্য সবাইকে শেষ করে শুধু তোমাকে। তোমাকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এখনো শুরু করে নি, কিন্তু ইচ্ছা করলেই পারে। তোমার নিয়ন্ত্রণটুকু নিয়ে নিলে আমাদের আর কোনো উপায় থাকবে না, তুমি তখন সিসিয়ানকে যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারবে।
অনেকক্ষণ সিডিসি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকে। যখন কথা বলে, তখন তার গলার স্বর বিষণ্ণ, আস্তে আস্তে অনেকটা আপন মনে বলে, আমি কখনো ভাবি নি আমার একদিন শেষ হয়ে যেতে হবে।
আমরাও কেউ সেটা ভাবি নি সিডিসি।
লু, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, লু। আমার খুব ইচ্ছে করছে থেকে যাই।
আমি দুঃখিত সিডিসি।
খুব ইচ্ছে করছে বেঁচে যাই। কোনো বড় মহাকাশযানে নয়, কোনো ছোট ছেলের খেলাঘরে তার খেলার সাথী হয়ে থেকে যাই।
আমি দুঃখিত সিডিসি।
কতবার আমি মহাকাশ পারাপার দিয়েছি, কতবার কত গ্রহ-নক্ষত্রে ঘুরে বেরিয়েছি, কত মহাকাশচারীর দুঃখ-বেদনার সাথী হয়ে কাটিয়েছি। কত স্মৃতি, কত অভিজ্ঞতা, সব চোখের পলকে শেষ হয়ে যাবে, কোথাও কিছু থাকবে না? সিডিসি ২১১২, ওমেগা গোষ্ঠীর ষষ্ঠ কম্পিউটারের চতুর্থ পর্যায় আর থাকবে না?
আমি দুঃখিত সিডিসি।
সত্যি তুমি চাও আমি যাই?
আমি দুঃখিত সিডিসি, কিন্তু আমি সত্যিই তাই চাই, আমার নিজের জন্যে নয়। পৃথিবীর জন্যে।
দীর্ঘ সময় সিডিসি চুপ করে থাকে, তারপর আস্তে আস্তে বলে, বিদায় লু। বিদায় সুশান, নীষা, কিম জিবান আর রু-টেক। বিদায়।
বিদায়।
নরম গলায় নীষা বলল, আমরা তোমায় মনে রাখব সিডিসি, সারা জীবন তোমাকে মনে রাখব।
নীষা।
বল।
যাবার আগে তোমাকে একটা উপহার দিয়ে যেতে পারি?
দাও।
তোমার ঘরে টেবিলের উপর রেখে গেলাম, যদি কখনো সুযোগ হয় দেখো।
দেখব।
বিদায়, সবাই।
বিদায়।
পর মুহূর্তে সিডিসি ২১১২, ওমেগা গোষ্ঠীর ষষ্ঠ কম্পিউটারের চতুর্থ পর্যায় তার অপারেটিং সিস্টেম২৫ আর আটচল্লিশ টেরা বাইট মেমোরি ধ্বংস করে ফেলল।
অন্ধকার নেমে এল সিসিয়ানে সাথে সাথে।
০৭. অনাহুত আগন্তুক
কন্ট্রোলরুমে আবছা অন্ধকার, সিডিসি ধ্বংস করে দেয়ার পর সিসিয়ানে একটা বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে। মহাকাশযানের জটিল কাজকর্মগুলি দূরে থাকুক, বাতাসের চাপ বা তাপমাত্রা ঠিক রাখার মতো ছোটখাট জিনিসগুলি করতে গিয়ে পর্যন্ত সই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেবার পরেও কিছুতেই মূল দায়িত্বগুলিও পালন করা যাচ্ছে না। কন্ট্রোলরুমে সবাই যখন সিসিয়ানকে মূল কক্ষপথে ধরে রাখার চেষ্টা করছিল, তখন হঠাৎ দরজায় কার ছায়া পড়ে। সুশান আতঙ্কে নীল হয়ে গিয়ে ভাঙা গলায় বলল, কে, কে ওখানে?
ছায়ামূর্তি কোনো কথা না বলে আরো এক পা এগিয়ে আসে। সিসিয়ানে এখন। আলো খুব বেশি নেই, এগিয়ে আসার পরও তার চেহারা ভালো দেখা গেল না। সুশানের মনে হল, ট্রাইটনের বংশধর বুঝি মানুষের আকার নিয়ে চলে এসেছে। ভয়পাওয়া গলায় বলল, কে, কে ওখানে?
ছায়ামূর্তি খসখসে গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে, আমি জিজ্ঞেস করতে পারি, কে ওখানে?
লম্বা ছায়া ফেলে একজন মাঝবয়সী লোক এগিয়ে আসে, পরনে আধময়লা কাপড়, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। লোকটা চোখ পিটপিট করে বলল, আমি কোথায়?
এটি কোন জায়গা?
লু হঠাৎ করে বুঝতে পারে লোকটা কে এবং হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়েছে। ডান হাতে একটা থ্রটল চেপে ধরে গলা উঁচিয়ে বলল, এটি মহাকাশযান সিসিয়ান।
সত্যি যদি এটা একটা মহাকাশযান হয়, তা হলে এটা এত অন্ধকার কেন? এরকম এলোমেলোভাবে ঘুরছে কেন? তাপমাত্রা এত কম কেন? বাতাসের চাপ কি ঠিক করা হবে, নাকি এরকমভাবে রেখে একসময় ফুসফুসটাকে ফাটিয়ে দেওয়া হবে?
কিম জিবান গলা নামিয়ে লুকে জিজ্ঞেস করে, লোকটা কে?
নিশ্চয়ই শীতল-ঘরে ছিল। সিডিসি যাবার আগে জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়ে গেছে, সিডিসি ছাড়া তো আর জীবন্ত কাউকে শীতল রাখা যায় না।
কোথায় যাবার কথা ছিল ভদ্রলোকের?
জানি না, আমাদের জানার কথাও না। সিডিসি জানত।
লোকটি আরো এক পা এগিয়ে এসে রুক্ষ স্বরে বলল, গুজগুজ করে ওখানে কী কথা হচ্ছে? আমাকে কি কেউ কিছু-একটা বলবে?
লু কিম জিবানের হাতে টলটা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যায়। বলছি। আমার নাম লু, আমি এখানকার দলপতি।
এটি কী জিনিস?
এটি একটা মহাকাশযান, আসলে বলা উচিত এটি কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত একটা মহাকাশযান ছিল।
এখন কী হয়েছে?
লু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, একটা খুপরি, একটা ভাঙা ঘর, একটা উপগ্রহ, যা ইচ্ছে হয় বলা যায়।