সম্ভবত।
শুনে সবার কেমন জানি গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
লু হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের হাতে কতটুকু সময় আছে আমি জানি না, আমাকে কয়েকটা জিনিস বলে দিতে দাও। প্রথম কথাটি সবাই জান, আমরা এখন চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি আছি, আমাদের কী হবে বলা কঠিন। দ্বিতীয় কথাটি প্রথম কথাটি থেকেও ভয়ংকর, সম্ভবত আমাদের সাথে সাথে সারা পৃথিবী এখন প্রচণ্ড বিপদের মুখোমুখি আছে। যদি ট্রাইটন সত্যি সত্যি সিসিয়ানে করে পৃথিবীতে তার বংশধর পাঠাতে পারে, সেটি হয়তো আমাদের পৃথিবীকে গ্রাস করে নিয়ে আরেকটা কুৎসিত ট্রাইটন তৈরি করে দেবে। আমি তোমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি না, তার সময় পার হয়ে গেছে সত্যি কথা বলছি। কাজেই আমার মনে হয়, আমাদের প্রথম দায়িত্ব পৃথিবীকে রক্ষা করার চেষ্টা করা। তার জন্যে যদি–
লু অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে হঠাৎ চুপ করে যায়। খানিকক্ষণ নিজের আঙ্গুলগুলি মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে মাথা তুলে বলল, তার জন্যে যদি আমাদের সবাইকে নিয়ে সিসিয়ানকে ধ্বংস করে দিতে হয়, তাহলে সেটাই করতে হবে।
কেউ কোনো কথা না বলে পাথরের মতো মুখ করে চুপ করে থাকে। লু একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দলপতির দায়িত্ব সবাইকে রক্ষা করা, সবাইকে নিয়েধ্বংস হয়ে যাওয়া নয়, কিন্তু আমি সত্যি কোনো উপায় দেখছি না।
কেউ কোনো কথা বলল না। লু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমাদের কারো আপত্তি আছে?
সবাই মাথা নাড়ে, কারো কোনো আপত্তি নেই, এরকম একটা ব্যাপারে কারো আপত্তি থাকতে পারে না। এরা পুরো জীবনের বেশিরভাগ কাটিয়েছে মহাকাশে মহাকাশে। পৃথিবীতে থাকার সৌভাগ্য আর কয়জনের হয়? পৃর্থিবী নিয়ে ওদের আশ্চর্য একটা স্বপ্ন আছে, সেই স্বপ্ন কেউ ধ্বংস করে দিতে চাইলে তারা সেটা কী ভাবে হতে দেয়? তাদের তো সেভাবে বড় করা হয় নি।
লু কী একটা বলতে চাইছিল, রু–টেক বাধা দিয়ে বলল, তুমি সিসিয়ানকে ধ্বংস করবে কেমন করে? ট্রাইটন কি সেটা বন্ধ করে রাখে নি?
রেখেছে, কিন্তু ধ্বংস করা খুব সহজ, সৃষ্টিটাই কঠিন। আমরা যদি সত্যি সিসিয়ানকে ধ্বংস করতে চাই, কিছু একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারব। রু-টেক মাথা নেড়ে চুপ করে যায়।
তোমাদের সবাইকে এখন একটা দায়িত্ব দিচ্ছি, সবাইকে নিয়ে সিসিয়ানকে ধ্বংস করে দেয়ার সবচেয়ে কার্যকর একটা পথ খুঁজে বের করা।
লু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও, আমার সত্যি কিছু করার নেই।
কিম জিবান জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, লু, তোমার এত খারাপ লাগার কোনো কারণ নেই, এটা তোমার দোষ নয় যে, আমরা এই নরকে এসে হাজির হয়েছি। যখন যেটা করার প্রয়োজন সেটা করতে হবে না?
তা হয়তো হবে, কিন্তু আমি তোমাদের দলপতি, তোমাদের বাচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমার।
নীষা একটু ইতস্তত করে বলল, ল, ব্যাপারটা এতটা ব্যক্তিগতভাবে দেখার প্রয়োজন নেই, তুমি আমাদের দলপতি, কিন্তু তোমার উপর আমাদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কথাটা ঠিক না। তোমার দায়িত্ব ঠিক পরিবেশে ঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া। এই অবস্থায় আর কোনো উপায় নেই, তাই তুমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ, এটা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, তোমার সিদ্ধান্তটি সঠিক সিদ্ধান্ত, দুঃখজনক হতে পারে, কিন্তু সঠিক। আমাদের সবার চমৎকার জীবন কেটেছে, এখন যদি আমাদের মারা যেতে হয়, তা নিয়ে বাড়াবাড়ি দুঃখ করার কিছু নেই। পৃথিবীকে যদি ট্রাইটনের হাত থেকে বাচিয়ে দিতে পারি, সেটা নিয়ে বরং আমাদের হয়তো একটু অহঙ্কারই হওয়া উচিত।
লু নীষার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে, চমৎকার স্বচ্ছ মেয়েটার বিচার-বিবেচনা, খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। মাথা নেড়ে বলল, নীষা, তুমি বড় ভালো মেয়ে, আমার কষ্টটা তুমি কমিয়ে দিয়েছ। মুখের হাসিটা জোর করে ধরে রেখে বলল, সুশান, তুমি কিছু বললে না?
সুশান একটু চমকে উঠে দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমি খুব ভীতু মানুষ, মরতে আমার খুব ভয় করে। একটু থেমে আবার বলল, দুঃখ নয়, ভয়। মৃত্যুযন্ত্রণা নাকি খুব ভয়ানক।
বুয়ের মুখের হাসি মুছে সেখানে একটা গাঢ় বেদনার ছাপ এসে পড়ে। আস্তে আস্তে বলল, আমি দুঃখিত সুশান।
সুশান একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, তোমার দুঃখ পাবার কিছু নেই, তোমার দলে যদি একটা ভীতু মেয়ে থাকে, সে জন্যে তোমার দুঃখ পাবার কী আছে?
সবাই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। লু একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, রু-টেক, তুমি কিছু বলবে?
আমি দুঃখিত লু, যে, এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে হল। আমার নিজের জন্যে কোনো দুঃখ নেই, কারণ আমার ঠিক মৃত্যু হবে না, কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে আমার আরো একটা কপি আছে। কিন্তু তোমাদের তো কোনো কপি থাকে না। মানুষ এত অসাধারণ, কিন্তু তবু কত সহজে তারা শেষ হয়ে যেতে পারে! আমি দুঃখিত।
সিডিসি, তুমি কিছু বলবে?
আমি খুব দুঃখিত, এ ছাড়া আমার কিছু বলার নেই।
আমার সিদ্ধান্তে তোমার কোনো আপত্তি আছে?
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে সিডিসি উত্তর দিল, না, নেই।
লু খানিকক্ষণ একদৃষ্টে উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা সবাই আমার সিদ্ধান্তে রাজি হয়েছ বলে তোমাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এবারে আমি তোমাদের কাছে আরো একটা অনুরোধ করতে চাই।
কি?
প্রয়োজনে আমরা সবাইকে নিয়ে ধ্বংস হয়ে যাব, কিন্তু তার মানে এই নয়, আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করব না। আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেষ্টা করব।