সবাই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
সিসিয়ানের সবাইকে নিয়ে জরুরি সভা ডাকল লু। প্রচণ্ড একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে সিসিয়ানে, তার মাঝে লু মুখে একটা নির্লিপ্ততার ভাব কষ্ট করে ধরে রেখেছে, সেটা বজায় রাখার চেষ্টা করে হালকা স্বরে বলল, সিডিসি, তুমি বর্তমান অবস্থার একটা রিপোর্ট দাও।
রিপোর্ট দেয়ার বিশেষ কিছু নেই, সিডিসি নিরুত্তাপ স্বরে বলল, বেশিরভাগ জিনিস এখন এখানে অচল। আমাদের এখন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার উপায় নেই, কেন্দ্রীয় স্টেশনে যোগাযোগ করার ক্ষমতা নেই, হাইপারভাইভ দূরে থাকুক, সিসিয়ানের এখন কক্ষপথ পর্যন্ত পাল্টানোর উপায় নেই। ট্রাইটন থেকে বিশেষ তরঙ্গের রেডিও ওয়েভ এসে সবকিছু জ্যাম করে দিয়েছে। যেভাবে এটা করা হয়েছে সেটা অবিশ্বাস্য, যদি কখনো সময় আর সুযোগ হয়, সবাইকে বুঝিয়ে দেব। যাই হোক, এক কথায় বলা যায়, আমরা এখন পুরোপুরি ট্রাইটনের নিয়ন্ত্রণে। ট্রাইটন অনুগ্রহ করে আমাকে অচল করে দেয় নি, যদিও আমার ক্ষমতা এখন খুব সীমিত।
ট্রাইটন পুরো গ্রহটা একটা প্রাণী, ব্যাপারটা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, আমি কম্পিউটার, কোনো জিনিস আগে দেখে না থাকলে আমি সেটা অনুভব করতে পারি না। সুশান হয়তো ব্যাপারটা আমাদের বোঝাতে পারবে। পলের শরীর থেকে যে–প্রাণীটি বের হয়ে এসেছে, সেটি সম্পর্কেও আমার ধারণা খুব অস্পষ্ট, থলথলে নরম একটা প্রাণী স্টেনলেসের একটা ক্যাপসুল কী ভাবে ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে আমার জানা নেই। প্রাণীটি এখন দ্বিতীয় স্তরে একটা সীসার আস্তরণ দেয়া ঘরে আছে, ঘরটির বৈদ্যুতিক তারগুলি প্রাণীটি নষ্ট করেছে বলে আমি আর তাকে দেখতে পারছি না। আমি আরো অনেক কিছু বলতে পারি, কিন্তু আমার সময় কম বলে আমি এখন চুপ করছি।
লু সুশানের দিকে তাকিয়ে বলল, সুশান কিছু বলবে?
সুশান হাত নাড়ে, আমি আর নতুন কী বলব? সিডিসি যেটা বুঝতে পারে নি, মনে করো না আমি সেটা বুঝেছি। একটা আস্ত গ্ৰহ কী ভাবে একটা প্রাণী হতে পারে সেটা নিয়ে একটা জার্নালে আমি একবার একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম, সেটা নেহায়েৎই একটা কাল্পনিক প্রবন্ধ ছিল। প্রবন্ধটিতে দাবি করা হয়েছিল, এরকম প্রাণীর ক্ষমতা হবে অসাধারণ, কেন, সেটা সবাই বুঝতে পারছ। পৃথিবীতে যদি মানুষের ইতিহাস কখনো পড়ে দেখ, তা হলে দেখবে তারা সবসময়েই নিজেদের ভিতরে মারামারি করছে। পৃথিবীর সভ্যতা হয়েছে ছাড়া ছাড়াভাবে, কোনো জাতি যখন একত্র হয়ে নিজেদের উন্নতি করার চেষ্টা করেছে, তখন। অনেকবার আবার অনা জাতি এসে সেসভ্যতা একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। পৃথিবীর সব মানুষ যদি কখনো যুদ্ধবিগ্রহ না করে সবাই একত্র হয়ে নিজেদের পুরো সম্পদ মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞানের পিছনে ব্যয় কত, তা হলে মানুষ কত উন্নত হত চিন্তা করা যায় না।
মানুষের যে-সমস্যা, এ ধরনের প্রাণীর সে সমস্যা নেই। এই প্রাণী কোটি কোটি সংঘবদ্ধ মানুষের মতো নিজেদের ভিতরে কোনো বিরোধ নেই। শেটি কোটি মানুষের মস্তিষ্ক যদি একসাথে কাজ করে তার যেরকম ক্ষমতা হবে ট্রাইটনের ক্ষমতা হবে সে-রকম। কাজেই বুঝতে পারছ, এই গ্রহটি কত অসাধারণ!
এধরনের গ্রহের আবার একটা সমস্যাও আছে, আজীবন সেটি একা একা থাকে, কাজেই এর নুতন জিনিস শেখার সুযোগ নেই। আমরা যখন প্রথম ট্রাইটনের কাছে এলাম তার নিশ্চয় বিস্ময়ের সীমা ছিল না। আমাদের সম্পর্কে কিছুই জানত না, কত তাড়াতাড়ি কত কিছু শিখে নিয়েছে, সে তো তোমরা সবাই দেখলে।
সুশান একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার আর কিছু বলার নেই।
সুশান, নীষা জিজ্ঞেস করে, ট্রাইটনের বংশধর নিয়ে কিছু বলবে?
সুশান কাতর মুখে বলল, আমাকে সেটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করো না। এখনো মনে হলে আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রাণীটি নিঃসন্দেহে ট্রাইটনের বংশধর, পল কুমের শরীরে ছিল, সময় হলে বের হয়ে এসেছে। রু-টেকের শরীরে কিছু আছে কি না আমি জানি না—সম্ভবত নেই।
রু-টেক মাথা নেড়ে বলল, আমি সিডিসিকে নিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করেছি, আমার শরীরে কিছু নেই। আমরা যন্ত্র বলে আমাদের শরীরে এখন যদি কিছু না থাকে, ভবিষতে সেটা সৃষ্টি হতে পারে না। মানুষের বেলায় সেটি সত্যি নয়, তাদের মস্তিষ্কে গোপন একটা কোড় দিয়ে দেয়া যায় নিজের অজান্তে সেটা শরীরে অস্বাভাবিক বিক্রিয়া শুরু করে আশ্চর্য পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। পলের বেলায় নিশ্চয়ই তা-ই ঘটেছে।
সুশান মাথা নেড়ে বলল, ঠিকই বলেছ, জীববিজ্ঞানে এর একটা নাম আছে, গ্রট এনোমলি বলা হয়, ব্যাপারটা এখনো বিজ্ঞানীরা বুঝে উঠতে পারেন নি। যাই হোক, ট্রাইটনের বংশধর এখন ছোট, কিন্তু যেহেতু তাকে অনেক বড় হতে হবে, তাই তাকে অনেক বড় একটা গ্রহে যেতে হবে। সেই গ্রহের বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের প্রাচুর্য সম্ভব ট্রাইটনের মতো হওয়া দরকার, তোমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর মৌলিক পদার্থের প্রাচুর্যের সাথে ট্রাইটনের অনেক মিল রয়েছে। সম্ভবত সে-কারণেই এই দু’টি গ্রহেই প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল, যদিও দুটি একেবারে ভিন্ন মানের।
নীষা মাথা নেড়ে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, তুমি বলছ এই বংশধর জিনিসটা নিয়ে কোনো একটা গ্রহে ফেলে দিলে ধীরে ধীরে পুরো গ্রহটা আরেকটা ট্রাইটনে পরিণত হবে?