খানিকটা মানুষ, খানিকটা যন্ত্র, খানিকটা ট্রাইটনের অংশ।
কী বলছ তুমি।
আমি দুঃখিত সুশান, কিন্তু আমি সত্যি কথাই বলছি।
সুশান একটু দ্বিধা করে বলল, তাহলে আমি এখন কী করব?
আমি জানি না সুশান। তবে সত্যি যদি পলের কথামতো—
পলের কথামতো কী?
রু-টেক বিব্রত স্বরে বলল, আমার নিশ্চয়ই মাথার ঠিক নেই, আমি পলের মৃত্যুচিন্তা করছিলাম।
কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না, সুশান একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, না রু-টেক, আমি পারব না। এরকম একটা জিনিস আমি চিন্তাও করতে পারব না।
জানি, আমি রবোট বলেই হয়তো পেরেছি।
সুশান কোনো কথা না বলে পলের উপর ঝুঁকে পড়ে তার একটা হাত টেনে নেয় ইনজেকশান দেবার জন্যে, সাথে সাথে ভুরু কুঁচকে যায় তার। লু উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, কি হয়েছে সুশান?
পলের শরীর এত ঠান্ড্রা কেন? ও কি–
সিভিসি অনু সুরে বলল, আমি দুঃখিত সুশান, পল আর বেঁচে নেই। একটু আগে তার মস্তিষ্কে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল, মারা গেছে প্রায় সাথে সাথে।
কেউ কোনো কথা বলে না, সুশান আস্তে আস্তে পল কমের হাতটি সাবধানে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়। হাতের লম্বা সিরিঞ্জটি নিয়ে কী করবে ঠিক বুঝতে পারে না, অন্যমনস্কভাবে সিরিঞ্জের ভিতরে কমলা রঙের তরলটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে তার চোখ পানিতে ভিজে আসতে থাকে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারে না, হাতে-ধরে রাখা সিরিটি তার চোখের সামনে আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে।
মহাকাশযানের নিয়মানুযায়ী কান্না হচ্ছে চতুর্থ মাত্রার অপরাধ, সিডিসি তবু কাউকে সেটা মনে করিয়ে দিল না।
লু নিজের ঘরে মাথা টিপে ধরে বসে আছে, অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সিডিসি।
বলুন।
আমরা এখন কী করব?
আমি খুব দুঃখিত, কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া সত্যি কিছু করার নেই।
কিসের জন্যে অপেক্ষা করব?
আমি জানি না।
কিন্তু ট্রাইটনের নিশ্চয় কোনো পরিকল্পনা আছে, পলকে পাঠিয়েছে সে।
কিন্তু পল তো তার পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারে নি, বেচারা তো কিছু করার আগেই মারা গেল।
তা ঠিক, কিন্তু পরিকল্পনা নিশ্চয়ই আছে একটা।
খানিকক্ষণ কোনো কথা নেই। একটু পর সিডিসি আস্তে আস্তে বলল, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করব লু?
কর।
তুমি কী ভাবে বুঝতে পেরেছিলে পল আবার আগের মতো কথা বলবে?
জানি না। যখন আমার দিকে তাকাল তখন ওর নিষ্পলক দৃষ্টির ভিতরেও কোথায় জানি দেখা যাচ্ছিল আমাদের পলকে, প্রত্যেকবার আমি ওকে অনুনয় করছিলাম আর দেখছিলাম ওর দৃষ্টিতে একটু একটু করে পল ফিরে আসছিল।
তোমরা, মানুষেরা খুব আশ্চর্য! আমি সারা জীবন চেষ্টা করেও কখনো বুঝতে পারব না।
অবাক হবার কিছু নেই সিডিসি, মানুষ নিজেরাও কখনো মানুষকে বুঝতে পারে না।
সত্যিই তাই। মানুষের জীবন তাই এত সুন্দর। হাদি সবকিছু সবাই বুঝে ফেলত, বেঁচে থাকার কোনো অর্থই থাকত না তাহলে।
পলের মৃত্যুটা সবাইকে খুব ভেঙে দিয়েছে সিডিসি।
হ্যাঁ। বিশেষ করে সুশান, এমনিতে ওর মনটা খুব নরম। এ-ধরনের ব্যাপারের জন্যে একেবারেই সে তৈরি হয় নি।
কী করছে সে এখন?
সিডিসি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, ও এখন দ্বিতীয় স্তরে নেমে যাচ্ছে, সম্ভবত পল কুমের মৃতদেহের পাশে গিয়ে একটু বসবে।
লু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বেচারি!
পলের দেহটা রাখা হয়েছে দ্বিতীয় স্তরের একেবারে শেষ ঘরটিতে। স্টেনলেস স্টিলের কালো একটা ক্যাপসুলের ভিতরে, শূন্যের নিচে আশি ডিগ্রি তাপমাত্রায়। নির্জন অন্ধকার একটা ঘরে। সুশান বুকের ভিতরে কেমন একটা শূন্যতা অনুভব করে, এক সপ্তাহ আগেও কি কেউ জানত, পলের এরকম একটা পরিণতি হবে?
সুশান সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে। পলের মৃতদেহটি যে-ক্যাপসুলে আছে সে খানিকক্ষণ তার পাশে বসে থাকবে। ব্যাপারটি পুরোপুরি অর্থহীন, কিন্তু সবকিছুরই কি অর্থ থাকতে হয়?
কালো স্টেনলেস স্টিলের একটা ক্যাপসুল, হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখে, মসৃণ পৃষ্ঠে নিষ্করুণ শীতলতা। সুশান ফিসফিস করে বলল, পল কুম, তোমাকে আমরা ভুলব না।
ঠিক তখন একটা শব্দ হল, সুশান প্রথমে ঠিক বুঝতে পারে না কোথায়। আবার অস্পষ্ট একটা শব্দ হল, সাথে সাথে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠে সুশান। ক্যাপসুলের ভিতর কী যেন নড়ছে। পল কুমপ্রাণ ফিরে পেয়েছে ভিতরে? আসলে কি সে মারা যায় নি? এই ধরনের কয়েকটা অযৌক্তিক জিনিস মাথায় খেলে যায় তার।
আবার অস্পষ্ট একটা শব্দ হয়, কেউ যেন মুচড়ে মুচড়ে কিছু একটা ভেঙে ফেলছে ভিতরে। সুশান পায়ে পায়ে পিছনে সরে আসে, আতঙ্কে হঠাৎ তার চিন্তা গোলমাল হয়ে যেতে থাকে। কিছু বোঝার আগে ক্যাপসুলের একটা অংশ হঠাৎ সশব্দে ফেটে যায়, আর ভিতর থেকে কিলবিলে কী যেন একটা বেরিয়ে আসে। আধা তরল আধা স্বচ্ছ থলথলে জিনিসটা ছটফট করতে করতে কেমন জানি ঘরঘর শব্দ করতে থাকে, হলুদ একটা ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় জায়গাটা ঢেকে যেতে থাকে।
কয়েক মুহূর্ত সুশান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ রক্ত-শীতলকরা স্বরে চিৎকার করে ছুটতে শুরু করে। ভয় পেয়েছে সে, অস্বাভাবিক জান্তব একটা ভয়।
হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো কাঁদছিল সুশান, লু তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কি হয়েছে সুশান? বল, কি হয়েছে?
অনেক কষ্টে সুশান বলল, বংশধর। ট্রাইটনের বংশধর বেরিয়ে এসেছে। পলের শরীর থেকে।