আমাদেরটা নিশ্চয়ই ট্রাইটনের অধিবাসীরা জাম করে দিয়েছে।
নীষ কিছু না বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, ট্রাইটনের অতিকায় লাল বৃত্তটা এখন দুত ছোট হচ্ছে, ছোট হয়ে আবার বড় হবে, তারপর আবার ছোট হবে, ঠিক যেরকম পল বলেছিল।
পল আসছে। এসে সে কী করবে?
০৬. প্রভু ট্রাইটন
স্কাউটশিপটা সিসিয়ানের ডকে এসে থামল। দরজা আটকে যাওয়ার পরিচিত শব্দ হল প্রথমে, বাতাসের চাপ এক হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে ওরা, তারপর দরজা খুলে যায়। প্রথমে টাইটেনিয়ামের দরজা, তারপর সিলঝিনিয়ামের দরজা, সবশেষে স্বচ্ছ প্লেক্সি গ্লাসের দরজা। দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় পল, দেখে শিউরে ওঠে সবাই। তাকে এখন আর চেনা যায় না, আশ্চর্য পরিবর্তন হয়েছে ওর। সারা মুখের চামড়া টানটান হয়ে আছে, দেখে মনে হয় কেউ যেন তাকে ঝলসে দিয়েছে আগুনে, শরীরের চামড়া যেন ছোট হয়ে আর তাকে ঢাকতে পারছে না, দাঁতগুলি বেরিয়ে আসতে চাইছে মুখ থেকে। শরীরের রঙে কেমন যেন নীলচে একটা ধাতব ভাব এসে গেছে। পল যখন হেঁটে হেঁটে এগিয়ে এল, সবাই দেখল তার হাঁটার ভঙ্গি সম্পূর্ণ অন্য রকম, দেখে মনে হয় যেন মানুষ নয়, একটা অর্থহীন যন্ত্র।
কারো দিকে না তাকিয়ে পল সোজা হেঁটে যাচ্ছিল, লু ওকে একবার ডাকল। পল কিছু শুনতে পেল মনে হল না, লু তখন আবার গলা উঁচিয়ে ডাকল। পল হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়, তারপর খুব ধীরে ধীরে ঘুরে লু’য়ের দিকে তাকায়। তার নিস্পলক দৃষ্টি দেখে হঠাৎ এক অবর্ণনীয় আতঙ্কে লু’য়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইল, তবু সে সাহস করে ডাকল, পল, আমাকে চিনতে পারছ, আমি লু।
পল লু’য়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, লু তখন একটু এগিয়ে এসে বলল, পল কথা বল তুমি, আমি ল, সিসিয়ানের দলপতি।
একটা ধাতব শব্দ হল হঠাৎ, ঠোট না নড়িয়ে আশ্চর্য শব্দ করা শিখেছে পল। সিডিসি অনুচ্চ স্বরে বলল, সাবধান লু, তোমাকে আর এগুতে নিষেধ করছে।
লু তবু এক পা এগিয়ে যায়, গলার স্বরে একটা অনুনয়ের সুর এনে বলল, পল, কিছু-একটা বল, এভাবে দাঁড়িয়ে থেকো না।
পল হঠাৎ আশ্চর্য ক্ষীপ্রতায় ওকে ধরে ফেলে, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড জোরে ছুড়ে দেয় একপাশে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে চোখে অন্ধকার দেখে লু, কষ্ট হয় ওর নিঃশ্বাস নিতে। সবাই ছুটে আসছিল, লু হাত তুলে খামতে ইঙ্গিত করে তাদের। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেয় কয়েকবার, তারপর শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে একটু ভিজিয়ে নিয়ে বলল, পল, তুমি কেন এমন করলে?
আবার আশ্চর্য একটা শব্দ করল পল।
তুমি আমাদের সাহায্য করবে না পল? তুমি তো আমাদেরই একজন।
পল তবু কিছু বলে না।
কিছু-একটা বল, লু অনুনয় করে বলে, আমি জানি তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ।
পল আবার একটা শব্দ করে।
লু কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে, খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে যায়, কাছে গিয়ে সে হঠাৎ সবাইকে অবাক করে পলের দুই হাত আঁকড়ে ধরে বলল, পল, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?
পল ধীরে ধীরে নিজের বাম হাত তুলে লু’য়ের কাপড় ধরে নিজের দিকে টেনে আনতে থাকে। লু কাতর স্বরে বলল, পল, একটা কথা বল।
পল খুব ধীরে ধীরে প্রায় শোনা যায় না এমনভাবে বলল, কষ্ট, অনেক কষ্ট।
কেন পল, কিসের কষ্ট?
ল’য়ের কথার উত্তর না দিয়ে পল বলল, তোমাদের অনেক বড় বিপদ।
কেন?
অনেক কষ্ট, পল নিজের মুখ বিকৃত করে যন্ত্রণাকাতর স্বরে বলল, অনেক কষ্ট আমার, আমাকে মেরে ফেল তোমরা, দোহাই তোমাদের।
পলের শরীর কাঁপতে তাকে, হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে সে। লু তাকে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। পল দু হাতে মুখ চেপে ধরে গোঙানোর মতো শব্দ করে।
পল, লু মাথা নামিয়ে বলল, কেন তোমার এত কষ্ট? কোথায় তোমার কষ্ট?
মাথায়। আমাকে মেরে ফেল। দোহাই তোমাদের!
পল, তুমি ট্রাইটনের প্রাণীদের দেখেছ?
পল মাথা নাড়ে।
কেমন দেখতে তারা? কী করে তারা?
তারা নয়, পল মাথা নাড়ে, তারা মাত্র একজন।
মাত্র একজন? অবিশ্বাসের স্বরে বলে, মাত্র একজন?
হ্যাঁ।
কেমন দেখতে সে?
তোমরা দেখেছ তাকে।
দেখেছি?
হ্যাঁ।
কখন দেখেছি?
সে ট্রাইটন।
ট্রাইটন?
হ্যাঁ।
মানে গ্রহটা?
হ্যাঁ।
পুরো গ্রহটা একটা প্রাণী?
হ্যাঁ।
কয়েক মুহূর্ত কেউ কথা বলতে পারে না। ল’য়ের পেটের ভিতরে কী-যেন একটা পাক দিয়ে ওঠে, ভয়ের একটা কাঁপুনি যেন মেরুদণ্ড দিয়ে বেয়ে যায়।
তোমাদের অনেক বড় বিপদ। ট্রাইটনের বংশধরকে তোমাদের সাথে নিতে হবে।
সে কোথায়?
পল হঠাৎ দু’ হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে বলল, আমাকে মেরে ফেল তোমরা, দোহাই তোমাদের!
সুশান এগিয়ে এসে পলের হাত ধরে, তোমাকে ত্রিশ মিলিগ্রাম রনিয়াম দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেব পল, কোনো ভয় নেই তোমার।
পল মাথা নাড়ে, আমাকে কেউ ঘুম পাড়াতে পারবে না। আমার মাথায় যন্ত্রণা–
কে বলেছে, এই দেখ তুমি। সুশান মেডিকেল কিট থেকে লম্বা সিরিঞ্জ বের করে রনিয়াম টেনে নিতে থাকে।
আমার মনে হয় পল সত্যি কথাই বলছে।
রু-টেকের গলার স্বর শুনে সবাই ঘুরে তাকায়, সে স্কাউটশিপ থেকে কখন বের হয়ে এসেছে কেউ লক্ষ করে নি। হাইপারডাইভ দেবার সময় তার মেমোরিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, সিডিসি নিশ্চয়ই আবার সেটা ফিরিয়ে দিয়েছে। রু-টেক সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, আমার মনে হয় না তুমি ওকে ঘুম পাড়াতে পারবে সুশান।
কেন?
পল এখন আর পল নেই।
সে তাহলে কী?