কথা শুনে রু-টেক ঘুরে দাঁড়ায়, ওর মুখে ক্লান্তির ছাপ, চোখে বোবা আতঙ্ক।
কি হয়েছে রু-টেক?
পলের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, কিছুতেই কমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। হিলিয়াম কম্প্রেশারটির বারটা বেজে যাচ্ছে, আর কতক্ষণ টিকে থাকবে, জানি না। তুমি যদি বল চেষ্টা করে যেতে পারি, কিন্তু কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে চেষ্টা করে লাভ নেই। তুমি নিশ্চয়ই দেখেছ ট্রাইটনে এখন তিনটা লাল বৃত্ত দেখা দিয়েছে, ঠিক যেরকম পল বলেছিল।
দেখেছি।
পলের মস্তিষ্কে যে কোডটা পাঠানো হয়েছে, এখন সম্ভবত আমরা সেটা জানতে পারব।
সম্ভবত।
মনে হচ্ছে কোডটা কী, দেখা ছাড়া আমাদের আর অন্য কোনো উপায় নেই। পল মনে হয় জ্ঞান ফিরে পাবেই, তাকে শীতল রাখার কোনো রাস্তা দেখছি না।
না।
কাজেই সে চেষ্টা না করে তাকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় নিয়ে এস, দেখা যাক কি হয়।
বেশ।
আর শোন রু-টেক, অবস্থা আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে চাইলে আমরা সম্ভবত হাইপারভাইভ দেব, তুমি প্রস্তুত থেকো। এক মিনিটের নোটিশে তোমাকে তোমার পুরো মেমোরি সিডিসির কাছে পাঠাতে হতে পারে।
আমার মিলি সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না।
চমৎকার! আর শোন, ভয়ের কিছু নেই, তুমি ঘাবড়ে যেও না। এখন ইচ্ছে করলে তুমি তোমার ভয়ের সুইচটা বন্ধ করে দিতে পার, কি বল?
হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছিলাম।
রু-টেক মাথার পিছনে কোথায় হাত দিয়ে কী-একটা সুইচ বন্ধ করে দিতেই তার ভিতর থেকে ভয়ের ভাবটা সরে যায়। হালকা স্বরে বলে, পলের তাপমাত্রা কেমন বেড়ে উঠছে দেখেছ? আর মিনিট দশেকে জ্ঞান ফিরে পাবে মনে হচ্ছে। ক্যাপসুল থেকে বের করে ফেলি, কি বল? জ্ঞান ফিরে যদি দেখে অন্ধকার কবরে শুয়ে আছে, খামোক ভয় পাবে। এমনিতে ভীত মানুষ, ভয় পেয়ে কী না কী করে ফেলবে কে জানে। রু-টেক দুলে দুলে হাসতে শুরু করে।
লুয়ের একটু হিংসা হয়, সেও যদি রু-টেকের মতো তার ভয়ের সুইচটা বন্ধ করে দিতে পারত।
পলকে কালো সিলিন্ডারের ভিতর থেকে বের করে আনা হয়েছে। তার শরীরের নানা জায়গায় নানা ধরনের সেন্সর লাগানো, মাথার কাছে নীল মনিটরে এখনো জীবনের কোনো স্পন্দন দেখা যাচ্ছে না। সবাই রুদ্ধশ্বাসে বসে আছে। কন্ট্রোলরুমে একটা লাল বাতি সেকেন্ডে একবার জ্বলে উঠে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে সিসিয়ান হাইপারডাইভ দেবার জন্যে প্রস্তুত।
ট্রাইটনে তিনটি লাল বৃত্ত বড় হয়ে একটা লাল বৃত্ত হয়ে যেতেই পলের ভিতরে পরিবর্তনের চিহ্ন দেখা যায়, তার হৃৎস্পন্দন শুরু হয়ে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন বাড়তে থাকে। রক্তচাপ বাড়তে বাড়তে একসময়ে স্থির হয়ে আসে।
সবাই চুপচাপ বসে ছিল। রু-টেক নীরবতা ভেঙে বলল, পলের শরীরে আশ্চর্য কিছু পরিবর্তন হচ্ছে।
কি রকম পরিবর্তন?
তার ফুসফুসে একটা জখম ছিল, আমি অস্ত্রোপচার করে মোটামুটি ঠিক করে দিয়েছিলাম, সারতে মাসখানেক সময় নিত। জখমটা এখন সেরে যাচ্ছে।
মানে! লু অবাক হয়ে বলল, সেরে যাচ্ছে মানে?
রু-টেক হেসে বলল, সেরে যাচ্ছে মানে বোঝ না? যেটা ভালো হতে একমাস সময় নেবার কথা সেটা কয়েক মিনিটে ভালো হয়ে যাচ্ছে। আরো শুনবে? ওর পাঁজরের যে হাড়টা ভেঙে গিয়েছিল সেটা জোড়া লেগে গেছে। শুধু তাই না, ওর মাংসপেশীতেও কিছু-একটা হচ্ছে, যার জন্যে সেটার ভিতরে এখন প্রচণ্ড শক্তি থাকার কথা। রক্তে লোহিত কণিকা বেড়ে গেছে অনেক, সব মিলিয়ে বলা যায় ওর শরীরে যেন একটা চমৎকার ওভারলিং হল। তোমরাও কেউ যাবে নাকি ট্রাইটনে, নবযৌবন ফিরে পাওয়া যায় মনে হচ্ছে!
রু-টেক শব্দ করে হাসে, কিন্তু তার রসিকতাটুকু কেউ উপভোগ করতে পারল বলে মনে হল না। লু গম্ভীর মুখে বলল, পল জ্ঞান ফিরে পেলে জানিও।
ট্রাইটনের বড় বৃত্তটি যখন ছোট হতে শুরু করে ঠিক তখন পল কুমের জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ খুলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে, রু-টেক তার উপর ঝুকে পড়ে বলল, কেমন আছ পল?
পল তার কথার উত্তর দেয় না, শুনতে পেয়েছে সেরকম মনে হল না।
পল, রু-টেক আবার ডাকে, পল, শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?
পল খুব ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে।
কেমন লাগছে এখন তোমার?
পল নির্লিপ্তর মতো বলল, ভালো।
ওর গলার স্বর শুনে সবাই কেমন জানি শিউরে ওঠে, প্রাণহীন ধাতব আশ্চর্য একটা স্বর।
রু-টেক হালকা গলায় বলল, তুমি জান, তোমার শরীরে যেসব জখম ছিল সব ভালো হয়ে যাচ্ছে?
পল আবার মাথা নাড়ে।
তুমি জান, সেটা কেমন করে হয়েছে?
পল খুব ধীরে ধীরে রু-টেকের দিকে তাকায়, খানিকক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, জানি।
আবার সেই শুস্ক ধাতব গলার স্বর।
লু তখন কথা বলে, কেমন করে হয়েছে পল?
পল তার উত্তর না দিয়ে আশ্চর্য একটা অশরীরী শব্দ করে। লু অবাক হয়ে বলল, তুমি কী বললে পল?
পল তার কথার উত্তর না দিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে উপরের দিকে গকিয়ে থাকে। লু চিন্তিত মুখে সিডিসিকে জিজ্ঞেস করল, সিডিসি, তুমি বুঝতে পারলে পল কী বলেছে?
পেরেছি, ওটা ভিন্ন ভিন্ন শব্দতরঙ্গের পারস্পরিক উপস্থাপন, সেটাকে বিশ্লেষণ করলে তার মানেটা হয় অনেকটা এরকম, পৃথিবীর মানুষ, আমাকে নিয়ে যাও।
মানে?
ট্রাইটনের কোনো অধিবাসী সম্ভবত আমাদের সাথে পৃথিবীতে যেতে চাইছে। লু মুখ শক্ত করে বলল, না, আমরা এখন কাউকে নিতে পারব না।
পল হঠাৎ করে উঠে বসে, তারপর ঘুরে লু’য়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এখন সিসিয়ানে আসব।