লু আবার বলল, কিম, দেখি একবার জিনিসটা।
কিম জিবান অত্যন্ত অনিচ্ছার সাথে তার দেয়া কৃত্রিম রংগুলি সরিয়ে নেয়, সাথে সাথে গ্রহটি তার পুরো বীভৎসতা নিয়ে ফুটে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না, আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস সাবধানে বের করে দিয়ে রু-টেক বলল, চল, ফিরে যাই।
সবাই রু-টেকের দিকে ঘুরে তাকায়। রু– টেক মহাকাশযান সিসিয়ানের একমাত্র রবোট, তার কাজকর্মের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না, কাজেই এধরনের কথাবার্তা শুধু সে-ই বলতে পারে। রু-টেক সবার দিকে তাকিয়ে বলল, কি, ভুল বললাম কথাটা? জিনিসটা দেখে কপোট্রনও গরম হয়ে উঠছে না? খামোকা ওটার কছে যাওয়ার দরকার কি?
রু–টেকের চমৎকার গলার স্বর তার যান্ত্রিক চেহারা এবং নিষ্পলক চোখের সাথে মোটেই খাপ খায় না, কিন্তু সে দীর্ঘদিন থেকে সিসিয়ানে আছে, আজকাল কেউ সেটি আর আলাদা করে লক্ষ করে না। লু রু–টেকের দিকে ঘুরে বলল, যাওয়ার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই, কিন্তু আমার ইচ্ছাই তো সবকিছু নয়।
তোমার ইচ্ছাই তো সবকিছু, রু–টেক তার সবুজাভ চোখের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে বলল, তুমি আমাদের দলপতি, তুমি শুধু মুখে একবার বলবে, আমরা ফিরে যাব, সিডিসি সাথে সাথে সিসিয়ানকে ঘুরিয়ে নেবে।
তোমার সব কিছুতে ঠাট্টা, কিম জিবান মনিটরে রংগুলি ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, এ রকম একটা ব্যাপার নিয়েও তোমার ঠাট্টা।
ঠাট্টা? ঠাট্টা কোথায় দেখলে?
আমরা কেন ফিরে যাব? একটা কারণ দেখাতে পারবে? কিম জিবান মুখে আলগা একটা গাম্ভীর্য এনে বলল, আমরা আছি এমন একটা মহাকাশযানে, যেটা প্রয়োজন হলে হাইপার ডাইভ দিতে পারে, সব মিলিয়ে এরকম মহাকাশযান তিরিশটাও আছে কি না সন্দেহ। এটা একটা অনুসন্ধানী মহাকাশযান, অথচ এখানে যে পরিমাণ ফিউসান বোমা আছে, সেটা দিয়ে একটা ছোটখাট মহাযুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া যায়। উপরের ঐ লাল সুইচটাতে তিনবার টোকা দিলে চারটা আক্রমণকারী মহাকাশযান এক ঘন্টার ভিতরে এসে হাজির হয়ে আমাদের উদ্ধার করে নেবে। সিনিয়ানের কোনো ক্ষতি হলে এক মাইক্রোসেকেন্ডের ভিতর আমাদের শরীরকে তিন ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় জমিয়ে নিয়ে ক্যাপসুলে ভরে নেবে। উদ্ধারকারীদল এসে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে সার্ভিস সেন্টারে, সেখানে তিন শ ডাক্তার আর চার হাজার যন্ত্রপাতি মিলে ধীরে ধীরে আম, শরকে উফ করে আমাদের রক্ষা করবে। আমরা হচ্ছি মানুষ, মানুষের সংখ্যা বেশি না, তাদের নিয়ে ছেলেখেলা করা হয় না। তুমি রবোট, তুমি এসব বুঝবে না—
রু-টেক কিম জিবানের মাথায় চাটি মেরে থামিয়ে দেয়, নাও নাও, বড় বড় বক্তৃতা শুনে কানের সার্কিট পুড়ে যাবার অবস্থা! মানুষ হলেই খালি বড় বড় বক্তৃতা দিতে হয়? আমাকে কখনো দেখেছ বক্তৃতা দিতে?
তাই তো বলছি, কিম জিবান সাবধানে মাথাটা রু-টেকের চাঁটি থেকে বাঁচিয়ে রেখে বলল, তুমি বুঝবে কি বক্তৃতা দেওয়ার মজা!
সুশান একটু এগিয়ে এসে বলল, ঠাট্টা নয় রু–টেক, তুমি অন্তত একটা যুক্তি দেখাও, কেন আমাদের গ্রহটিতে না গিয়ে ফিরে যাওয়া উচিত।
শুনবে, শুনবে তোমরা?
সবাই মাথা নাড়ে। সুশান তার ছেলেমানুষি চোখ বড় বড় করে বলল, কোনো একটা যুক্তি দেখিয়ে যদি ফিরে যাওয়া যায়, খারাপ কী?
রু-টেক গম্ভীর হয়ে বলল, যুক্তিটা খুব সহজ।
কি?
আমাদের ভালো লাগছে না।
সুশান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ব্যস?
হ্যাঁ।
সে অনাদের দিকে তাকায়, রু- টেক ঠাট্টা করছে কি না এখনো বুঝতে পারছে।
পল কুম তার কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, মহাকাশযানের কী একটা ধারার কী একটা অংশে নাকি আছে যে সবার যদি একসাথে কোনো একটা কাজ অপছন্দ হয়—কোনো কারণ ছাড়াই, তাহলে নাকি সেটা না করলে ক্ষতি নেই।
রু– টেক এক হাতে অন্য হাতের উপর আঘাত করে একটা ধাতব শব্দ করে বলল, বললাম না। আমি ভুল বুলি কখনো? চল ফিরে যাই।
পল কুম কোমল দৃষ্টিতে রু-টেকের দিকে তাকিয়ে ছিল, সে দলের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য, জীববিজ্ঞানী দু’জনের আরেকজন। সারাজীবন পশু-পাখির জটিল মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছে, তাই মানুষের হাতে তৈরি রু-টেকের আশ্চর্য মানবিক অংশটুকু তাকে এত অভিভূত করে। কোনো একটা অজানা কারণে সবার ভিতরে একটা আশ্চর্য অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে, রু-টেক সেটা বুঝতে পেরে চেষ্টা করছে সবাইকে ফিরিয়ে নিতে। পল কুম কোমল গলায় বলল, রু।
রু-টেক পলের দিকে তাকিয়ে বলল, কি হল?
আমি যতদূর জানি সেই ধারাটিতে আছে, দলের সব সদস্যের যদি কোনো কারণে অস্বস্তি হয়, তাহলে সেই অভিযান বাতিল করা সম্ভব।
রু-টেক সাথে সাথে বুঝে যায়, পল কুম কী বলতে চাইছে, কিন্তু তবু হাল ছেড়ে না দিয়ে সে শেষ চেষ্টা করে, আমিও তো তাই বলছি, সবার মনে হচ্ছে গ্রহটি অশুভ–
পল কুম বাধা দিয়ে বলল, সবার?
রু-টেক মাথা চুলকানোর ভান করে বলল, হ্যাঁ তাই তো দেখা যাচ্ছে।
পল কুম একটু হেসে বলল, তুমি এখনো ভালো করে মিথ্যা কথা বলা শেখ নি। আমার সাথে সাথে কয়দিন থাক, চোখের পাতি না ফেলে কিভাবে মিথ্যা কথা বলতে হয় শিখিয়ে দেব।
রু-টেক চোখ বারকয়েক সামনে-পিছনে নাড়িয়ে বলল, কেন, আমি আবার কী মিথ্যা কথাটা বললাম?
আমাদের সবার ভিতরে যে-রকম একটা অশুভ হয়েছে, তোমার ভিতরে তা হয় নি। মানুষ লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফল, আমাদের কোনো এক পূর্বপুরুষ কী একটা দেখে ভয় পেয়েছিল, সেটা এখনো আমাদের রক্তের মাঝে রয়ে গেছে, তাই এখনো কিছু কিছু জিনিস কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের অশুভ মনে হয়। মানুষ এখনো অন্ধকারকে সহজভাবে নিতে পারে না, গুহাবাসী মানুষের সব বিপদ অন্ধকারে ওত পেতে থাকত বলেই হয়তো। কিন্তু তুমি তো কোনো বিবর্তন দিয়ে আস নি, তোমাকে ফ্যাক্টরিতে তৈরি করা হয়েছে, তুমি কেন গ্ৰহটাকে অশুভ মনে করবে?