সিডিসি কিছু না বলে চুপ করে থাকে।
কিছু একটা বল সিডিসি।
আমার কিছু বলার নেই লু। তবে—
তবে কি?
তোমার অবস্থা আমি পুরোপুরি অনুভব করতে পারছি লু। তোমাকে খুব কাছে থেকে দেখার পর থেকে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে, এটা হয়তো আমার সৌভাগ্য যে আমি একজন মানুষ হয়ে জন্ম নিই নি, মানুষের জীবন অনেক কঠিন। যাই হোক, আমি যদি বলি, ট্রাইটনের অধিবাসীরা সম্ভবত পলকে দ্বিতীয়বার তৈরি করবে না, তুমি কি একটু সান্ত্বনা পাবে?
লু ভুরু কুঁচকে সিডিসির দিকে তাকায়, কিন্তু সিডিসি একজন মানুষ নয় যে তার চোখের দিকে তাকিয়ে মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবে। ছোট্ট মাইক্রোফোন, যেটা দিয়ে সিডিসি কথা বলে, সেটার দিকে তাকিয়ে কিছুই বোঝার উপায় নেই। লুয়ের কয়েক মুহূর্ত লাগে কথা বলতে, পাথরের মতো মুখ করে সে বলল, সিডিসি, তুমি কি কিছু-একটা জান, যেটা আমি জানি না?
সিডিসি একটু হাসির মতো শব্দ করে বলল, আমি সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার, আমাকে সবকিছু জানতে হয়, সেসব তোমার জানার কথা নয়, জানার প্রয়োজনও নেই।
সিডিসি, তুমি কথা ঘোরানোর চেষ্টা করো না, তুমি খুব ভালো করেই জান আমি কী বলতে চাইছি। তুমি কি কিছু-একটা জান, যেটা আমি জানি না?
আমি দুঃখিত লু, তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না।
রু-টেক কি কিছু একটা জানে, যেটা আমি জানি না? তার মেমোরি হঠাৎ করে খরচ হয়ে গেল কেমন করে? কী আছে সেখানে?
আমি দুঃখিত ল, আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারব না। তাছাড়া রু-টেক চতুর্থ মাত্রার রবোট, তার মেমোরিতে কী আছে সেটা কারো জানার অধিকার নেই, তাকে মানুষের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
গত আটাশ ঘন্টায় কি পলকে একাধিকবার তৈরি করা হয়েছে, যা তোমরা আমাদের জানাও নি?
আমি দুঃখিত লু, তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়।
লু হতবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, যখন কথা বলে তখন রাগে তার মুখ থমথম করছে, সিডিসি, তুমি জান আমি হচ্ছি সিসিয়ানের দলপতি, তুমি একটা সাধারণ কম্পিউটার, এখানে সিদ্ধান্ত নিই আমি, তুমি শুধু আদেশ পালন কর।
আমি জানি লু। আমি খুবই দুঃখিত যে তুমি আমাকে ভুল বুঝছ, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার করার কিছু নেই–
লু চিৎকার করে বলল, কিন্তু আমাকে যদি সবকিছু জানতে না দাও তাহলে তুমি জানবে কি করে কোন কোন কাজ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে করা হচ্ছে না?
তোমার যা জানার প্রয়োজন সবকিছু আমি তোমাকে জানাই।
পল আর রু-টেককে নিয়ে প্রথম প্রথম যে স্কাউটশিপগুলি বেরিয়েছিল তুমি সেসব উড়িয়ে দিয়েছ, আমাকে কি তুমি তা জানিয়েছ?
আমি একবারও বলি নি যে আমি স্কাউটশিপ ধ্বংস করেছি।
কিন্তু তুমি তা অস্বীকারও কর নি, করেছ?
আমি দুঃখিত, তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না।
টেবিলে প্রচণ্ড থাবা দিয়ে লু বলল, এক শ’ বার দিতে হবে, আমি এখানকার দলপতি।
আমি দুঃখিত লু যে তুমি ব্যাপারটিকে এভাবে দেখছ। সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার হিসেবে আমাকে অসংখ্য জিনিস করতে হয়, সবকিছু তোমাকে বলা সম্ভব নয়, যেসব বলা প্রয়োজন সবসময়েই তোমাকে বলে থাকি। কোনটা বলা প্রয়োজন, কোনটা প্রয়োজন নয় সেটার সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আমার, আমাকে সেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে। তোমাকে শুধু একটি জিনিস বলে রাখি, কখনো যদি কোনো জিনিস তোমার কাছে গোপন করা হয়, সেটা তোমার ভালোর জন্যেই করা হয়, আমার এই কথাটি শুধু তুমি বিশ্বাস কর।
লু আপন মনে মাথা নাড়ে, সেজন্যেই বিস্ফোরকের হিসেব মিলছে না, স্কাউটশিপগুলি ওড়াতে গিয়ে বিস্ফোরক খরচ হয়েছে, হিসেব মিলবে কেমন করে? – টেককে নিশ্চয়ই তুমি ব্যবহার করেছ, তার মেমোরি এক স্কাউটশিপ থেকে আরেক স্কাউটশিপে পাঠানো তো তোমার কাছে ছেলেখেলা। রু-টেক আর তুমি জান কি হয়েছে, আর কেউ জানে না। আমাকে না জানিয়ে এরকম একটা কাজ তুমি করতে পারলে, তোমাকে এত বড় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে? তুমি জান, তুমি মানুষ খুন করেছ? তুমি জান, মানুষ খুন করা কত বড় অপরাধ?
সিডিসি কিছু বলার আগে হঠাৎ করে দরজা খুলে কিম জিবান ঝড়ের মতো এসে ঢোকে, থমথমে মুখে বলে, লু তোমার সাথে কথা আছে।
কী কথা?
তুমি নাকি রু-টেককে বলেছ, সে কিংবা পল, দু’ জনের কেউ এখন সিসিয়ানে আসতে পারবে না?
বলেছি।
কিম জিবান অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে বলল, তুমি বলেছ?
হ্যাঁ, বলেছি।
তুমি জান সিসিয়ানে জীবনরক্ষাকারী ক্যাপসুল আছে, পলকে তার মাঝে এনে রাখলে সে বেঁচে যাবে?
জানি।
তবু তুমি তাকে এখানে আনছ না, রু-টেককে বলেছ ডাক্তার সেজে তার উপর অস্ত্রোপচার করতে? সে জীবনে একফোঁটা রক্ত পর্যন্ত দেখে নি!
তা সত্যি।
অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে কিম জিবান খানিকক্ষণ লু’য়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার মুখে কথা ফুটতে চায় না। অনেক কষ্টে আস্তে আস্তে বলে, তোমাকে ভেবেছিলাম একজন খাঁটি মানুষ। আসলে তুমি খাঁটি মানুষ নও, খাঁটি মানুষের নিজের প্রাণের জন্যে এত মায়া থাকে না, যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করতে করতে তোমার অনুভূতি এখন যন্ত্রের মতো হয়ে গেছে, এখন তুমি যন্ত্রের মতো চিন্তা কর। পলের জন্যে তোমার কোনো অনুভূতি নেই, সে মরে গেলে তোমার কিছু আসে-যায় না। যতক্ষণ অন্য সবাইকে নিয়ে তুমি বেঁচে থাকতে পার, ততক্ষণ তুমি খুশি।
লু’য়ের মাথার মাঝে একটা অন্ধ রাগ দানা বাঁধতে থাকে। কিম জিবানের মুখে প্রচণ্ড আঘাত করে তাকে থামিয়ে দেয়ার ইচ্ছাটাকে অনেক কষ্ট করে সে আটকে রাখে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে কিম জিবানের উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, ছেলেমানুষি মুখটা দেখতে দেখতে ওর রাগটা আস্তে আস্তে কমে আসে। বরং হঠাৎ করে ওর ভিতরে কেমন জানি একটি আশ্চর্য দুঃখবোধ জেগে উঠতে থাকে।