একটু হাসির শব্দ হল প্রথম, তারপর ভরাট গলায় কে যেন বলে, তোমাদের বুঝে ওঠা খুব মুশকিল। যখন আমার মনে হয় কাউকে পুরোপুরি বুঝে ফেলেছি, তখন সে এমন একটা কাজ করে, যে, আমাকে আবার প্রায় গোড়া থেকে শুরু করতে হয়।
লু চমকে উঠে বলল, কে? কে কথা বলছে?
আমি। আমি সিডিসি।
সিডিসি?
শ্রী।
নীষা তোমার প্রোগ্রাম পাল্টে দিয়েছে বুঝি?
ঠিক ধরেছ। চমৎকার মেয়েটি নীষা।
হ্যাঁ।
একটু চুপচাপ, কিন্তু চমৎকার!
হ্যাঁ।
কী?
এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সিডিসি বলল, একটা কথা বলব?
বল।
আমার কী ভয় হচ্ছিল, জান? কী? ‘
ভয় হচ্ছিল যে, ট্রাইটনের অধিবাসীরা আমাকে অচল করে দেবে। ইচ্ছা করলেই কিন্তু পারে, চারটা ভিন্ন ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি যদি পিকো সেকেন্ড পরে পরে পাঠায়, সেন্ট্রাল সি পি ইউটা অচল হয়ে থাকবে। ওরা পাঠিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছে, আমি জানি। কিন্তু আমাকে অচল করে দেয় নি।
সত্যি?
সত্যি। শুধু তাই নয়, আরো একটা কাজ করেছে ওরা।
কি?
তেইশ মেগাসাইকেলের ব্যান্ডটা অচল করে রেখেছে।
তার মানে তুমি আর কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে পারবে না?
না।
ল চিন্তিতভাবে নিজের ঠোঁটটা কামড়াতে থাকে।
সিডিসি একটু পরে বলল, সবকিছু দেখে আমার কী মনে হচ্ছে জান?
কী?
মনে হচ্ছে তোমাদের নিয়ে ট্রাইটনের প্রাণীদের কোনো-একটা পরিকল্পনা আছে। তোমাদের তারা এই মুহূর্তে কোনো ক্ষতি করতে চায় না। আবার তোমাদের যেতে দিতেও চায় না।
ঠিক।
তাই মনে হচ্ছে, তুমি ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছ, আমাদের একটু অপেক্ষা করে দেখতে হবে।
লু কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। সিডিসি একটু পরে বলল, লু, তোমার হয়তো একটু ঘুমানোর চেষ্টা করা উচিত।
ঠিকই বলেছ সিডিসি।
ব্যবস্থা করে দেব? চমৎকার কিছু ক্লাসিক্যাল মিউজিক আছে আমার কাছে, আমার নিজের খুব প্রিয়। হালকা সুরে লাগিয়ে দেব?
ঠিক আছে, দাও।
লু জেগে জেগে ক্লাসিক্যাল মিউজিক শুনতে থাকে, স্বীকার না করে পারে না, সিডিসির সংগীতজ্ঞান খারাপ নয়, তার নিজের থেকে অনেক ভালো।
০৪. যোগাযোগ : প্রথম পর্ব
অপেক্ষা করার মতো ভয়ংকর জিনিস আর কিছু নেই, বিশেষ করে যদি জানা না থাকে ঠিক কিসের জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছে। সিসিয়ানের সবাই এখন এই ভয়ংকর অবস্থার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সময় কাটানো নিয়ে অবশ্যি সে-রকম সমস্যা নেই, ট্রাইটনের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেই একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। এখন সবাই জানে এই গ্রহে কোনো একধরনের প্রাণী আছে, যার বুদ্ধিমত্তা অসাধারণ। সবাই চেষ্টা করছে তাদের খুঁজে বের করতে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, পুরো গ্রহ ভন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো প্রাণী, তাদের ঘরবাড়ি বা সভ্যতা, কোনোকিছুই পাওয়া যায় নি। সিসিয়ানে যেসব যন্ত্রপাতি আছে সেগুলি ব্যবহার করে গ্রহের ভিতরে মাটির নিচে অনেকদূর পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা যায়, কিন্তু সবরকম চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয় নি, প্রাণীগুলি যেন বাতাসে উবে গেছে।
পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টা এভাবেই কেটে গেল। প্রথম প্রথম সবাই লু’য়ের কথা বিশ্বাস করেছিল, ভেবেছিল সত্যি পল কুম আর রু-টেককে নিয়ে স্কাউটশিপটা ফেরত আসবে। প্রথম চার ঘন্টা পর স্কাউটশিপের মতো কী-একটা সত্যি সত্যি দেখাও গিয়েছিল, কিন্তু সিডিসি ভালো করে দেখে জানিয়েছে, যে-যান্ত্রিক গোলযোগ, স্কাউটশিপজাতীয় কোনোকিছু নেই। এই সুদীর্ঘ সময়ে কেউ কিছু করতে পারে নি, অপেক্ষা করার সময় কেন জানি কোনো কাজ করা যায় না। যোগাযোগের সবরকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নীষা আবার তার ভাষা তৈরি করার কাজে ফিরে গেছে। কিম জিবান ট্রাইটনে কী ভাবে আঘাত করা যায় সেটার চিন্তা ভাবনা করতে থাকে, কী পরিমাণ বিস্ফোরক আছে খোঁজখবর নিতে গিয়ে একটা আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করে, বিস্ফোরক যেটুকু থাকার কথা, তার থেকে অল্প একটু কম রয়েছে। এমন কিছু জরুরি ব্যাপার নয়, কিন্তু কী ভাবে কমেছে কিম জিবান সেটার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। কিম জিবান জিনিসটা ল’কে জানিয়ে রাখল, কিন্তু লু খুব বেশি বিচলিত হল বলে মনে হল না, গত কয়েকদিনে যেসব অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটেছে, তার তুলনায় এটা কিছুই না।
নীষা তার ভাষায় নতুন ধরনের ক্রিয়াপদের নিয়মকানুনগুলি ঠিক করে কফি খাওয়ার জন্যে উঠে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ট্রাইটন থেকে প্রথমবার একটা সংকেত এসে হাজির হয়। প্রথমে একবার তারপর বারবার; অনেকবার। দুর্বোধ্য ইলেকট্রনিক সংকেত, সেটাকে বোধগম্য ভাষায় অনুবাদ করার জন্যে সে পাগলের মতো চেষ্টা করতে থাকে। অচেনা ভাষাকে নিজের ভাষায় অনুবাদ করার রুটিনবাঁধা পদ্ধতি আছে, কিন্তু উত্তেজনায় সহজ জিনিসগুলি নীষার ওলট-পালট হয়ে যেতে থাকে।
নীষা।
সিডিসির গলার স্বর শুনে চমকে ওঠে নীষা, কি হল?
তোমাকে অনুবাদ করতে হবে না, রু-টেক ট্রাইটন থেকে কথা বলছে।
বিস্মিত নীষা সুইচ টিপে দিতেই সত্যি সত্যি রু-টেকের গলার স্বর শুনতে পায়, আমি রু– টেক বুলছি। সিসিয়ান সাড়া দাও। আমি রু– টেক বলছি। সিসিয়ান সাড়া দাও।
আমি নীষা, রু–টেক, আমি নীষা। তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?
স্কাউটশিপের ভিতর থেকে।
স্কাউটশিপটা কোথায়?
জানি না, তোমরা বলতে পারবে নিশ্চয়ই।
নীষা উত্তর দেবার আগেই সিডিসি কথা বলল, রু–টেক, তোমরা ট্রাইটনের পৃষ্ঠে আছ, আমি যেটুকু দেখছি তাতে মনে হচ্ছে স্কাউটশিপটার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু এখনো ব্যবহার করা সম্ভব। ইনজিন চালু করে দিলেই ওখান থেকে বেরিয়ে আসবে, আমি বাকি সবকিছু ব্যবস্থা করে নেব।