মহামান্য ল, স্কাউটশিপটাকে বাঁচাতে গিয়ে আমি প্রথমবার আমার পুরো শক্তি ব্যয় করেছি, স্কাউটশিপটাকে বাঁচাতে পারি নি, কিন্তু তবুও আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, এটি একটি অপুর্ব অভিজ্ঞতা। বুদ্ধিমত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ বলতে পারেন–
লু পা দিয়ে সুইচটা বন্ধ করে সিডিসিকে চুপ করিয়ে দিল, এই মুহূর্তে বুদ্ধিমত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের আলোচনায় কারো উৎসাহ নেই। স্কাউটশিপটা বিধ্বস্ত হয়ে যাবার পর লু সবাইকে নিয়ে বসেছে, সিডিসি কথা বলার অনুমতি চাওয়ায় তাকে অনুমতি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তার কথা শোনার মতো মনের অবস্থা কারো নেই। লু ঠোঁটটা কামড়ে থেকে খানিকক্ষণ কী—একটা ভেবে বলল, তোমাদের কারো নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ নেই যে, এই গ্রহে মানুষ থেকে অনেক বুদ্ধিমান কোনো একধরনের প্রাণী আছে। আমাদের এই মুহূর্তে হাইপারভাইভ দিয়ে পালিয়ে যাবার কথা। লু এক মুহূর্ত থেমে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে কেউ কিছু বলতে চায় কি না, কিন্তু কারো কিছু বলার নেই দেখে সে আবার শুরু করে, আমি কিন্তু এই মুহূর্তে হাইপারডাইভ দিতে রাজি না, পলকে বাঁচানোর কোনোরকম চেষ্টা না করে আমি এখান থেকে যেতে চাই না। আমার সিদ্ধান্তে কারো আপত্তি আছে?
সবাই মাথা নেড়ে জানায়, কারো আপত্তি নেই, সিডিসি ছাড়া। সে তীব্র স্বরে বি বিপ্ শব্দ করে জানায় যে, তার আপত্তি আছে। লু তাকে অগ্রাহ্য করে আবার শুরু করতে যাচ্ছিল, নীষা বাধা দিয়ে বলল, সিডিসির আপত্তিটা কোথায়, শুনলে হত না?
লু অনিচ্ছার সাথে সিডিসিকে কথা বলার সুযোগ করে দিতেই সে বলল, মানবজাতির উন্নতির প্রধান অন্তরায় হচ্ছে তাদের অযৌক্তিক আবেগপ্রবণ অনুভুতি। মহামান্য পল কুমকে আগের অবস্থায় ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। তার প্রাণরক্ষা করার চেষ্টা করতে গেলে সিসিয়ানের অন্যান্যদের প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে। কাজেই আমার বদ্ধমূল ধারণা, মহামান্য পল কুমকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে এই মুহূর্তে আমাদের পালিয়ে যাওয়া উচিত। ট্রাইটনে অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, তারা যেভাবে স্কাউটশিপটাকে নামিয়েছে, সেটি বিস্ময়কর। আমার মতো অসাধারণ কম্পিউটার পর্যন্ত সেটি রক্ষা করতে পারে নি। অভিজ্ঞতাটি অপূর্ব, কিন্তু
নীষা সুইচ টিপে সিডিসির কথা বন্ধ করে দেয়। লু ক্লান্ত গলায় বলল, নীষা, তুমি একবার বলেছিলে সিডিসির প্রোগ্রামের কী-একটা পাল্টে দিলে সে আর নির্বোধের মতো কথা বলবে না।
হ্যাঁ, বলেছিলাম।
কখনো সুযোগ পেলে প্রোগ্রামটা পাল্টে দিয়ে তো, আর সহ্য করা যাচ্ছে না!
দেব।
লু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কারো কিছু বলার আছে?
কিম জিবান মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
কি?
পলকে উদ্ধার করার জন্যে কী করবে?
কিছু না।
কিছু না? কিম জিবান একটু অবাক হয়ে তাকায়, কিছু করবে না?
লু ম্লানমুখে একটু হাসে, কী করব, বল? সমান সমান হলে যুদ্ধ করা যায়, কিন্তু এখানে তুমি কী করবে? আমার মনে হয়, অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। সিডিসিকে বলব, কিছু-একটা করা যায় কি না ভেবে দেখতে, কিন্তু আমার মনে হয় না সে কিছু ভেবে বের করতে পারবে। অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই কিম।
শুধু অপেক্ষা করা?
হ্যাঁ। আমার বিশ্বাস স্কাউটশিপটা আবার ফেরত আসবে, ভিতরে থাকবে পল আর র। জৈবিক পদার্থটি পাঁচ চেষ্টায় তৈরি হয়েছিল, পলকে তৈরি করতে হয়তো আরেকটু বেশি সময় নেবে।
ভয়ের একটা শিরশিরে ভাব সুশানের সারা শরীরকে কাঁপিয়ে দেয়। ফ্যাকাসে মুখে বলল, তুমি সত্যি বিশ্বাস কর, পলকে ওরা তৈরি করার চেষ্টা করবে?
হাঁ, আমি বিশ্বাস করি। এই মুহূর্তে হয়তো ওরা পলকে টুকরা টুকরা করে খুলে দেখছে। নিশ্চয় সব কিছু ওরা জেনে যাবে। পলের স্মৃতি থেকে হয়তো আমাদের সম্পর্কেও জানবে। লু হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে হালকা গলায় বলল, অবশ্যি এটা আমার ধারণা, সত্যি নাও হতে পারে।
সিডিসি বিপ বিপ করে কী একটা বলতে চেষ্টা করল, কেউ তাকে গ্রাহ্য করল না।
লু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা বিশ্রাম নাও। সামনে কী আছে জানি না। কিম, তুমি হাইপারড়াইভের সব ব্যবস্থা করে রেখো, কয়েক সেকেন্ডের নোটিশে আমরা যেন হাইপারডাইভ দিতে পারি। নীষা, ভূমি মহাকাশকেন্দ্রে একটা খবর দিয়ে রাখ, আমাদের কী করা উচিত জানতে চেও না, ফেরত যেতে বলবে। সিডিসি, তুমি সিসিয়ানকে আরো এক হাজার কিলোমিটার সরিয়ে নাও, ট্রাইটনের এত কাছে থেকে কাজ নেই।
নীষা বলল, ল, তুমি একটা জিনিস বলতে পারবে, এই গ্রহে যদি এত উন্নত প্রাণী থাকে, তা হলে তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে না কেন?
জানি না, মনে হয় পারছে না। মনে নেই পল কুম বলেছিল, মানুষ কখনো পিপড়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না, অনেকটা সেরকম হয়তো।
কিন্তু তাই বলে একবার চেষ্টাও করবে না?
করছে হয়তে, পল আর রু–টেককে নিয়ে যাওয়া হয়তো সেই চেষ্টার একটা নমুনা। তাদের ফিরিয়ে দিয়ে হয়তো দেখাবে যে তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করতে চায় না।
তোমার ভাই ধারণা?
জানি না, লু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পল থাকলে বলতে পারত।
সবার বুকে কেমন জানি একটা মোচড় দিয়ে ওঠে, বেচারা পল।
ঘন্টাখানেক পরে লু নিজের ঘরে বিশ্রাম নিতে এসেছে। ট্রাইটনে অসাধারণ ক্ষমতাবান কোনো একধরনের প্রাণী আছে জানার পর থেকে ওর ভিতরে একটা আশ্চর্য অনুভূতি হচ্ছে, একটা অসহায় অনুভূতি হঠাৎ করে সে যেন বুঝতে পারে, ল্যাবরেটরির খাঁচার ভিতরে একটা গিনিপিগের কেমন লাগে। লু যে-জিনিসটি নিয়ে আরো বেশি বিভ্রান্ত, সেটা হচ্ছে তার নেতৃত্ব। এই পরিস্থিতিতে সে কি ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে? সে কি বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে অহেতুক প্রাণের ঝুঁকি নিচ্ছে? কারো সাথে কথা বলতে পারলে হত, কিন্তু কাকে বলবে? সিডিসিকে শুনিয়ে শুনিয়ে মাঝে মাঝে সে হালকা কথাবার্তা বলে থাকে। আজকেও অনেকটা সেভাবে শুরু করে দিল, বুঝলে সিডিসি, মহাকাশযানের নেতা হওয়া খুব কষ্টের কাজ। সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি নিজের দায়িত্বে নিতে হয়। এখানে থেকে যাওয়াটা খুব বিপদের কাজ হচ্ছে, কিন্তু আমি কী করব? পলকে না নিয়ে আমি যাই কেমন করে, আমি জানি সে ফেরত আসবে, আমার কেমন একটা বিশ্বাস আছে। কিন্তু ঝুকিটা কী বেশি নিয়ে নিলাম? আমি নিজের প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারি, কিন্তু অন্যদের প্রাণ নিয়ে তো আমি ছেলেখেলা করতে পারি না। সবচেয়ে ভালো হত কি হলে জান? সবচেয়ে ভালো হত, যদি এখন দেখা যেত ট্রাইটনের অধিবাসীরা আমাদের জোর করে আটকে রেখেছে, হাইপারডাইত দিতে দিচ্ছে না। আমাকে তা হলে আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হত না।